চাপে ঠুঁটো রাজ্য, ফিরছে শব্দবাজি
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এক শীর্ষকর্তা তাঁর আশঙ্কার কথা রাজ্য পরিবেশ দফতরের এক কর্তার কাছে বলতে গিয়ে থ হয়ে গিয়েছেন।
জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায়ে অন্য রাজ্যের মতো পশ্চিমবঙ্গেও বাজির শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেল থেকে বেড়ে হয়েছে ১২৫ ডেসিবেল। এর ফলে এ বার উৎসবের মরসুমে শব্দবাজির তাণ্ডবে কান পাতা দায় হবে, সাধারণ মানুষ বিস্তর ভোগান্তিতে পড়বেন এই সব কথা সবে বলতে শুরু করেছিলেন ওই পর্ষদ-কর্তা। কিন্তু পরিবেশ দফতরের ওই কর্তা তাঁকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে সাফ বলে দেন, “এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। বছরে মাত্র কয়েকটা দিনই শব্দবাজি ফাটে, আগেও ফেটেছে। এতে দুনিয়া রসাতলে যাওয়ার মতো কিছু ঘটে না!”
বিমূঢ় পর্ষদ-কর্তা কিছু বলে উঠতে পারেননি। কিন্তু রাজ্য পরিবেশ দফতরের মনোভাব দেখে তিনি বিস্মিত হয়ে যান।
সরকারি সূত্রের খবর, মূলত পরিবেশ দফতরের চাপেই এ রাজ্যে বাজির শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল রেখে নির্দেশিকা জারি করতে চলেছে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ। পর্ষদ-কর্তাদের একাংশ বলছেন, জাতীয় পরিবেশ আদালতের ওই রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য যে সুপ্রিম কোর্টে যাচ্ছে না, ওই নির্দেশিকা জারির সঙ্গে সঙ্গেই সেটা স্পষ্ট হয়ে যাবে।
গত ২৯ অগস্ট জাতীয় পরিবেশ আদালত এই রায় দিয়েছে। পর্ষদের বিশেষজ্ঞদের মতে, ৯০ ডেসিবেলের মধ্যে ‘ক্যাপ’ বা ওই ধরনের চটপটির মতো কিছু বাজি ছাড়া শব্দবাজি তৈরি কার্যত অসম্ভব। সে হিসেবে ১৯৯৭-র অক্টোবর থেকে পশ্চিমবঙ্গে শব্দবাজি তৈরি, বিক্রি, ব্যবহার ও চালান নিষিদ্ধ ছিল।
সেপ্টেম্বর ১৯৯৭ বাজির শব্দসীমা নির্ধারণে দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদকে নির্দেশ হাইকোর্টের
অক্টোবর ১৯৯৭ ৯০ ডেসিবেল শব্দসীমা বাঁধল পর্ষদের ১০ সদস্যের কমিটি
জানুয়ারি ১৯৯৮ হাইকোর্টের রায় বহাল রাখল সুপ্রিম কোটর্র্
অক্টোবর ১৯৯৯ কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ শব্দসীমা ঠিক করে ১২৫ ডেসিবেল
সেপ্টেম্বর ২০০০ কেন্দ্রীয় পরিবেশ মন্ত্রক জানায়, পশ্চিমবঙ্গে ৯০ ডেসিবেল বৈধ
অক্টোবর ২০০৪ রাজ্যে ফাটবে না, এই শর্তে ১২৫ ডেসিবেলের বাজি তৈরির অনুমতি।
পরে ভুল বুঝতে পেরে নির্দেশ প্রত্যাহার করেছিল পর্ষদ
অগস্ট ২০১৩ রাজ্যেও শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল, জানাল জাতীয় পরিবেশ আদালত
হাইকোর্টের নির্দেশে পর্ষদের তৈরি ১০ জনের বিশেষজ্ঞ-কমিটি সব দিক বিবেচনা করে এই ৯০ ডেসিবেল-এর শব্দসীমা নির্ধারণ করেছিল। ইএনটি বিশেষজ্ঞ আবিরলাল মুখোপাধ্যায়, বায়োফিজিক্স-এর বিশেষজ্ঞ রমেন পোদ্দার, অল ইন্ডিয়া ইনস্টিটিউট অফ হাইজিন অ্যান্ড পাবলিক হেল্থ-এর অধিকর্তা কুমারজ্যোতি নাথ প্রমুখ ওই কমিটির সদস্য ছিলেন।
ইএনটি চিকিৎসকরা বলছেন, শব্দবাজি কানের পর্দার ক্ষতি তো করেই, এমনকী এর আচমকা ‘শক’-এ হৃদরোগীর মৃত্যুও হতে পারে। হৃদরোগ, মস্তিষ্কবিকৃতি হতে পারে সুস্থ লোকেরও। কিন্তু বাজির শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল হওয়া মানেই চকোলেট বোমা, দোদোমা, কালিপটকার মতো বিকট শব্দবাজি ছাড়পত্র পেয়ে গেল বলে জানাচ্ছেন পর্ষদ-কর্তারাই।
হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি তথা এই রাজ্যে বাজির শব্দসীমা বেঁধে দেওয়ার নির্দেশ যিনি জারি করেছিলেন, সেই ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশঙ্কা, “১২৫ কেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ডেসিবেলে ফাটা বাজি এ বার মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে।” তাঁর ব্যাখ্যা, “বাজির শব্দসীমা ৯০ ডেসিবেল রেখে আসলে প্রায় সব রকম শব্দবাজিকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল করা মানে, সমস্ত শব্দবাজিকে খুল্লমখুল্লা ছাড় দেওয়া। কারণ, বাজি শব্দ করে ফাটলে কোনটা ১২০ আর কোনটা ১৫০, সেটা কী করে বোঝা সম্ভব? সব সময় তো যন্ত্র নিয়ে ঘোরা সম্ভব নয়। এত বড় একটা কাণ্ডের পরেও পর্ষদ ও পরিবেশ দফতর চুপ কেন?”
পরিবেশকর্মী নব দত্তের কথায়, “সিপিএমের রাজত্বে শব্দবাজির দরজা একটু ফাঁক হয়েছিল, আর তৃণমূলের জমানায় সেই দরজা হাট করে খুলে গেল।” নববাবু জানান, পর্ষদ সুপ্রিম কোর্টে যাক বা না-যাক, পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলির কেন্দ্রীয় সংগঠন ‘সবুজ মঞ্চ’ সর্বোচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। গণস্বাক্ষর সংগ্রহ করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপও চাওয়া হবে।
বস্তুত, অন্দর থেকে বাধা ও আপত্তি আসার ফলেই পর্ষদ ও পরিবেশ দফতর যে বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে না-যেতে চাইছে, তার ইঙ্গিত মিলেছে রাজ্যের পরিবেশমন্ত্রী ও পর্ষদ চেয়ারম্যানের বক্তব্যে। পরিবেশমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদার বলেন, “জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায়ের পরে আমরা কী করব, এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারিনি। বিষয়টি নিয়ে অনেক বিতর্ক রয়েছে। আমরা সুপ্রিম কোর্টে যাব কি না, তা নিয়ে দফতরে আলোচনা চলছে। প্রয়োজনে মুখ্যমন্ত্রীর মত নিতে হবে।”
দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের চেয়ারম্যান বিনয়কান্তি দত্তও বলেন, “জাতীয় পরিবেশ আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হওয়া নিয়ে আমরা এখনও কোনও সিদ্ধান্তে নিতে পারিনি। সরকারের যে-স্তরে নীতি নির্ধারণ হয়, সেখানে আলাপ-আলোচনা চলছে।”
পর্ষদের অবসরপ্রাপ্ত মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় বলেন, “জাতীয় পরিবেশ আদালতের নির্দেশ সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপন্থী। কারণ পশ্চিমবঙ্গে বাজির শব্দসীমা ১২৫ ডেসিবেল করার আবেদন সুপ্রিম কোর্ট একাধিক বার খারিজ করে দিয়েছে। এই আইনি জায়গা থেকেই সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া দরকার ছিল।”
বিশ্বজিৎবাবুর কথায়, “১৯৯৭ থেকে এ পর্যন্ত এ রাজ্যে শব্দদূষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে প্রাণ দিয়েছেন ছ’জন। তাঁরা সরকারি ভাবে শব্দ-শহিদের মর্যাদা পেয়েছেন। শব্দবাজির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যেতে সেই রাজ্যের পরিবেশ দফতর ও দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের এত দ্বিধা কেন?” তাঁর বক্তব্য, “দেশের অন্য রাজ্যে আছে বলে আমাদের রাজ্যেও সীমা ১২৫ ডেসিবেল করতে হবে, তার কী মানে আছে? আমরা তো দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলাম। দেশের অন্য অংশে চালু থাকার যুক্তিতে কি মদ-নিষিদ্ধ রাজ্যগুলিতে মদ চালু করা যাবে?”
পরিবেশমন্ত্রীর যুক্তি, “রায়ের উপর স্থগিতাদেশ পাওয়া গেলেও শব্দবাজি না-ফাটার গ্যারান্টি কোথায়? এত দিন এই রাজ্যে শব্দবাজি নিষিদ্ধ ছিল, তা সত্ত্বেও কি শব্দবাজি ফাটেনি?”
মন্ত্রী যা-ই বলুন, গত বছরও গোটা রাজ্যে শব্দবাজি তৈরি, বিক্রি ও ফাটানোর অভিযোগে প্রায় এক হাজার লোককে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। তা ছাড়া, বেআইনি ভাবে যাঁরা শব্দবাজি তৈরি করতেন ও ফাটাতেন, তাঁদের কিছুটা ভয়ও থাকত। এ বার থাকছে না।
আসলে ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত শব্দবাজির ব্যবহার এই রাজ্যে মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও ২০০৪ সালে তদানীন্তন শাসক দল সিপিএমের চাপে এই রাজ্যে শব্দবাজির জন্য দরজা কিছুটা ফাঁক করে দেওয়া হয়। শব্দবাজি প্রস্তুতকারকদের সংখ্যা যে জেলায় সব চেয়ে বেশি, সেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার পার্টি এই নিয়ে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের কাছে দরবার করে। এবং পর্ষদ ওই চাপের কাছে নতি স্বীকার করে নতুন নির্দেশ জারি করে জানায়, ১২৫ ডেসিবেল শব্দসীমার বাজি অন্য রাজ্যে পাঠানোর জন্য এ রাজ্যে তৈরি করা যাবে। কিন্তু এ রাজ্যে বিক্রি ও ব্যবহার করা যাবে না।
ওই সুযোগের সদ্ব্যবহার করেই সে বার পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে দেদার শব্দবাজি ঢুকে পড়ে এই রাজ্যে। তাণ্ডব হয় দীপাবলিতে। ভুল বুঝতে পেরে নির্দেশ প্রত্যাহার করেছিল পর্ষদ।

পুরনো খবর


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.