হারিয়ে যেতে বসা কুড়মালি ভাষা এ বার পুরুলিয়ায় পড়ার সুযোগ করে দিচ্ছে সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়। তাদের অধীনস্থ কোন কলেজগুলি ওই ভাষা পড়াতে আগ্রহী তা জানতে চেয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। আপাতত স্মাতক স্তরে পাস কোর্সে ওই ভাষায় পাঠক্রম চালু করতে চাইছেন তাঁরা। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার নচিকেতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “উচ্চ শিক্ষা দফতরের অনুমতি পেয়েছি। কলেজগুলি ওই ভাষা পড়াতে আগ্রহ দেখালেই, অনুমতি দেওয়া হবে।” ইতিমধ্যে তাঁরা ওই ভাষার পাঠক্রম তৈরির কাজ শুরু করে দিয়েছেন।
বিহার, ঝাড়খণ্ড-সহ এ রাজ্যের জঙ্গলমহলের বেশ কিছু এলাকায় এখনও বহু মানুষ এই অতিপ্রাচীন ভাষায় কথাবার্তা বলেন। কয়েক বছর আগে ঝাড়খণ্ডের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কুড়মালি ভাষা শিক্ষা শুরু হয়েছে। এ রাজ্যে পুরুলিয়ার এই বিশ্ববিদ্যালয় তা প্রথম চালু করতে চলেছে। সম্প্রতি পুরুলিয়া শহরে সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয় ও ন্যাশনাল বুক ট্রাস্টের উদ্যোগে কুড়মালি ভাষা বিষয়ক তিন দিনের আলোচনা সভা হয়। তারপরেই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই পাঠক্রম চালু করার কথা ঘোষণা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রস্তাবে আগ্রহ দেখাচ্ছে কয়েকটি কলেজও। জয়পুর বিক্রমজিৎ গোস্বামী স্মৃতি মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ অসিত মাহাতো বলেন, “প্রচলিত বিষয়গুলির সঙ্গে এলাকার ভাষা ও সংস্কৃতির চর্চা করা হবে এমন লক্ষ্য নিয়েই এই বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছিল। আমরা কলেজে কুড়মালি ভাষা পড়াতে চাই।” বাঘমুণ্ডির সুইসা নেতাজি সুভাষ মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ কিঙ্কর দাসও তাঁদের কলেজে ওই ভাষা পড়াতে চান। সেই সঙ্গে তাঁর সংশয়, “কুড়মালির শিক্ষক পাওয়ার সমস্যা হতে পারে। এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগিতা প্রয়োজন।”
এই ভাষা শিক্ষা পেশাগত দিকে কতটা উপযোগী তা নিয়েও প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। কুড়মালি ভাষার গবেষক কিরীটী মাহাতোর মতে, “যে কোনও ভাষা শেখাটাই উপকারের। যাঁরা এই ভাষা শিখবেন তাঁরা পরবর্তীকালে শিক্ষকতায় আসতে পারেন। গবেষণারও সুযোগ রয়েছে। ঝাড়খণ্ডের রাঁচি বিশ্ববিদ্যালয়, চাঁইবাসার কোলহান বিশ্ববিদ্যালয়, হাজারিবাগের সন্ত বিনোবা ভাবে বিশ্ববিদ্যালয় ও দুমকার সিধু কানু মুর্মু বিশ্ববিদ্যালয় কুড়মালি পড়াচ্ছে। তা ছাড়া এই প্রচীন ভাষা সংরক্ষণেরও গুরুত্ব রয়েছে। নবীন প্রজন্মকে এ কাজে এগিয়ে আসতে হবে।” তিনি জানান, রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসুর কাছে তাঁরা বিদ্যাসাগর, বর্ধমান ও গৌড়বঙ্গ ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়েও এই ভাষা পড়ানোর অনুরোধ জানাবেন।
‘মুলকি কুড়মালি ভাকি বাইসি’ নামে সবর্ভারতীয় একটি সংগঠন কুড়মালি ভাষা ও সংস্কৃতি রক্ষার আন্দোলন করে আসছে। কিরীটীবাবু ওই সংগঠনের এ রাজ্যের সম্পাদক। তিনি জানান, এ রাজ্যের জঙ্গলমহলের বিস্তীর্ণ এলাকা-সহ উত্তরবঙ্গের বহু মানুষ এই ভাষায় কথা বলেন। এমনকী, সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গেও প্রাচীন কুড়মালি ভাষার মিল রয়েছে। কিরীটীবাবু বলেন, “ভারতবর্ষে যত প্রাচীন জনগোষ্ঠী রয়েছে, প্রত্যেকেরই নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতি রয়েছে। তেমনই কুড়মি সম্প্রদায়ের নিজস্ব ভাষা হল কুড়মালি। এই সম্প্রদায় কেরল, গুজরাট, ত্রিপুরা, ঝাড়খণ্ড, বিহার, পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের নানা এলাকায় ছড়িয়ে রয়েছে।”
এই ভাষার কবি অনন্ত কেশরিয়ার বা সুনীল মাহাতোর মতে, “এখন তো এ রাজ্যে মানুষের মুখে মুখেই এই প্রাচীন ভাষা টিঁকে রয়েছে। পঠনপাঠন হলে চর্চা বাড়বে, গবেষণা হবে, নতুন নতুন দিক আবিষ্কৃত হবে।” |