|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতাই ফুটে ওঠে আদিবাসীদের চিত্রে |
হ্যারিংটন স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত হল একটি সম্মেলক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
সম্প্রতিকালে আদিবাসীদের চিত্রকলা নিয়ে প্রচুর পর্যালোচনা হচ্ছে। তাঁদের ছবি আধুনিক মানুষের সামনে তুলে ধরার জন্য অনেক প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে। এর পিছনে এক জন শিল্পীর উদ্যোগ খুব ফলপ্রসূ হয়েছিল। তিনি জগদীশ স্বামীনাথন। ১৯৭০ দশকের শেষ দিকে তিনি ভূপালের ভারত ভবনের দায়িত্ব নিয়ে সেখানে আদিবাসী শিল্পের একটি সংগ্রহালয় গড়ে তোলেন। সেই চর্চা আদিবাসী শিল্পকে অনেকটাই বিশ্বের দিকে প্রসারিত করেছিল। সম্প্রতিকালে দিল্লিতে অর্পণা কাউরের সংগ্রহ এবং সেই সংগ্রহ নিয়ে একটি সুবিপুল গ্রন্থও এই প্রকল্পের বিস্তারে অনেক সহায়ক হয়ছে। এই সংযোগের ফলে আমাদের আধুনিক চিত্রকলা যেমন আদিমতাকে আত্মস্থ করেছে, তেমনি আদিবাসীদের ছবিও অনেক পরিশীলিত হয়েছে।
কলকাতায় সম্প্রতি আদিবাসী চিত্রকলা নিয়ে দু’টি বড় প্রদর্শনী হয়ে গেল। হ্যারিংটন স্ট্রিট আর্ট সেন্টারে দেখানো হল মধ্যপ্রদেশের গোণ্ড ও ভীল উপজাতির কয়েক জন শিল্পীর ছবি। এটি পরিকল্পনা করেছিলেন ইনা পুরী। এর কিছু দিন আগে বিড়লা অ্যাকাডেমিতে দেখানো হয়েছিল ‘আদি চিত্র’ শিরোনামে অনেকগুলি আদিবাসী সম্প্রদায়ের কাজ। ‘ট্রাইফেড’ সংস্থা আয়োজিত এই প্রদর্শনীটি পরিকল্পনা করেছিলেন শর্মিষ্ঠা মাইতি।
হ্যারিংটন স্ট্রিট আর্ট সেন্টারের প্রদর্শনীতে পাঁচ জন শিল্পীর ছবি ছিল: ভুরি বাঈ, দুর্গা বাঈ, রাজেন্দ্র শ্যাম, সুভাষ শ্যাম ও ভেঙ্কট রমন শ্যাম। প্রথম জন ভীল উপজাতির অন্তর্গত। বাকি সকলেই গোণ্ড। এই যে উপজাতি গোষ্ঠীভুক্ত জনগোষ্ঠী— এরাই আমাদের দেশের আদি মানুষ। উন্নত সভ্যতার বিস্তারের পর থেকে, তাঁরা গোষ্ঠীবদ্ধ ভাবে পাহাড় ও অরণ্যের এক একটি অঞ্চলে বসবাস করতে লাগল। খুব ধীরে ধীরে উন্নত সভ্যতার সঙ্গে তাঁদের সংযোগ ঘটেছে। তাঁদের শিল্পচর্চায় এর প্রভাব পড়েছে। প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা আদিবাসী শিল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য। আধুনিকের সঙ্গে এখানেই তাঁদের পার্থক্য। দুর্গা বাঈ-এর একটি ছবিতে দেখছি একটি গাছ, তার তলায় কয়েকটি পশু গাছের সঙ্গে মিলেমিশে রয়েছে। তাদের পিঠের উপর নিশ্চিন্তে বসে রয়েছে পাখিরা। তাঁদের বর্ণ-পরিকল্পনা একেবারেই স্বাভাবিকতাকে অনুসরণ করে না। ছবির বুনোট সমৃদ্ধ প্রজ্ঞাকে প্রতিফলিত করে। রাজেন্দ্র শ্যামের একটি ছবিতে প্রেক্ষাপট শূন্যতা পরিব্যাপ্ত। সারিবদ্ধ ভাবে অজস্র পাখি উড়ছে। সকলেরই নীল ডানা আর লালাভ শরীরে বিন্দু বিন্দু সাদার বুনোট। |
|
শিল্পী: রাজেন্দ্র শ্যাম |
সুভাষ ভ্যাম-এর একটি ছবিতে অজস্র মেষজাতীয় প্রাণীর জটলার মধ্যে রয়েছে পাইথন জাতীয় একটি সরীসৃপ। তার দেহের উপর বসে আছে পাখিরা। ভুরি বাঈ-এর ছবির জ্যামিতি একটু আলাদা। দু’টি ত্রিভুজের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে একটি পশু। তার পিঠের উপর বসে আছে এক জন মানুষ বিস্ময়বিমুগ্ধ দৃষ্টি মেলে। পশুটি মুখ বাড়িয়েছে গাছের ডালের দিকে।
বিড়লা অ্যাকাডেমির প্রদর্শনীটি ছিল আরও অনেক বিস্তৃত। সেখানে গোণ্ড, ভীল ছাড়াও আমরা দেখেছি মহারাষ্ট্রের ওয়ারলি, ওড়িশার সাওরা, গুজরাটের পিথোরা, বাস্তারের মুরিয়া ইত্যাদি উপজাতীয় শিল্পীদের ছবি। ওয়ারলিদের ছবিতে মানুষ বা পশুর অবয়ব একটি নির্দিষ্ট জ্যামিতিক ডিজাইন অনুসরণ করে। দু’টি ত্রিকোণের সমন্বয়ে গড়ে ওঠে তা। তাঁদের প্রকৃতিমুগ্ধতা, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা আদর্শ জীবনের দৃষ্টান্তস্বরূপ।
সাওরা চিত্র ওখানে যা ছিল অধিকাংশই ডিজাইনধর্মী। সেই ডিজাইনের মধ্যেও নিবিড় বুননে মিশে আছে প্রকৃতি ও জীবনের সমগ্র অনুষঙ্গ। পিথোরা চিত্রে ঘোড়ার ব্যবহার খুব দেখা যায়। ঘোড়ার পিঠে চড়ে যাচ্ছে মানুষ। তার সঙ্গে বাঘজাতীয় হিংস্র প্রাণীও মিলেমিশে আছে। কিন্তু তাদের হিংসা নেই। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে শুভ্র প্রেক্ষাপটে একটি গাছ উঠে গেছে সুরম্য ছন্দে ডালপালা ছড়িয়ে। ডালের উপর দু’পাশে দু’টি ময়ূর।
আর নীচে দু’টি হরিণ। অসামান্য ডিজাইন। ডিজাইনকে জড়িয়েই আনন্দের উদ্ভাস। মুরিয়াদের ছবিতে রচনাপদ্ধতি অনেক ঘনসংবদ্ধ। একটি ছবিতে দেখা যাচ্ছে কালো প্রেক্ষাপটে সাদায় আঁকা একটি হাটের অনুষঙ্গ। জীবনযাপনের সঙ্গে একাত্ম। বিচ্ছিন্নতা নেই। কিন্তু ছবি বলে, তাঁদের আনন্দ ও একাত্মতাকে কেড়ে নিতে পারেনি। |
|
|
|
|
|