সেই কবে “বাঙালির ছেলে বিজয় সিংহ লঙ্কা করিয়া জয়”... তার পর বাঙালির ইতিহাসে তো শুধুই পাঠান, মোগল, ব্রিটিশ শাসন। বিক্ষোভ-বিদ্রোহ করেছে, দেশ থেকে দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছে, কিন্তু উপনিবেশ তৈরির স্বপ্ন দেখেনি বাঙালি। ঘণ্টায় ১৩ হাজার মাইল বেগে ছুটে চলা মহাকাশযান থেকে যিনি ৯০০ কেজির রোবটযানকে পালকের মতো মঙ্গলে নামিয়েছিলেন, সেই বঙ্গতনয়া স্বপ্ন দেখেন ভিনগ্রহেও উপনিবেশ তৈরির! এবং তারই বীজ বোনেন দেশে-দেশে!
রোভার কিউরিওসিটির সফল অবতরণের কাহিনি শোনালেন অনিতা সেনগুপ্ত। কলকাতা সায়েন্স সিটির অডিটোরিয়ামে। তবে শুধু কলকাতার নয়, বর্ধমান-বাঁকুড়া-পুরুলিয়া থেকে আসা এক ঝাঁক পড়ুয়াকে নাসার এই বিজ্ঞানী বোঝালেন, কী ভাবে পেল্লায় এক প্যারাসুটে বড়সড় গাড়ির মাপের মঙ্গলযানকে প্রতিবেশী গ্রহে নামিয়েছেন তাঁরা। তার একটা খুদে সংস্করণও বার করে দেখালেন। বললেন, কী কী নিয়ে চিন্তা ছিল বেশি। কী ভাবে সামলালেন সে সব। কখনও ভিডিও, কখনও স্লাইড। মায়েরা যে ভাবে অনর্গল বলে যায় তার সন্তানের প্রথম মা ডাকের কথা, প্রথম হামাগুড়ির কথা, প্রথম দু’পায়ে দাঁড়ানো, এক পা বাড়ানোর কথা উজ্জ্বল চোখ দু’টি নিয়ে ঠিক সে ভাবেই বলছিলেন বাঙালি মেয়েটি। হবে না-ই বা কেন, মিস কিউরিওসিটি তো তাঁর ও তাঁর সতীর্থদের সন্তানেরই মতো। সবে যে সন্তান বছর পেরিয়েছে। সে সব দিনের-দিনই খবর হয়ে গিয়েছে।
এ দিনের খবরটা কী? নজরে এল চার পাশে ঘাড় ফেরাতেই। মন্ত্রমুগ্ধ সব কিশোর চোখ। কান খাড়া করে শুনছে। স্বপ্নমুগ্ধ! কী না, এক দিন মঙ্গলেও হয়তো থাকব আমরা। সময়টাকে একটু বড় করে নিলেন অনিতা। বললেন, “এমন হতে পারে, আজ এই ঘরে যাঁরা আছি, তাঁদের জীবনকালে কয়েক জন হয়তো পা রাখবেন প্রতিবেশী গ্রহটিতে। কিন্তু পরে কোনও এক দিন নিশ্চয়ই...” |
অনিতা সেনগুপ্তকে কলকাতার স্মারক। ছবি: দেবস্মিতা চক্রবর্তী। |
স্বপ্ন বোনার সেই আসরের শেষে সাংবাদিক বৈঠক। সেখানে শুধুই কিছু একেঘেয়ে প্রশ্ন, “মিষ্টি ভালবাসেন কি? “হ্যাঁ। ডেজার্ট অবশ্যই ভালবাসি।” থেমে থেমে বললেন, “রসগোল্লা, বরফি...।” তার পর যেটা উচ্চারণ করলেন, খুব সম্ভবত তা রসমালাই। যিনি রকেট পাঠান, তিনি শাড়িও পরেন! সেরা বাঙালির পুরস্কার মঞ্চে তো সে দিন শাড়ি পরেছিলেন! কিনলেন কলকাতা থেকে কয়েকটা? একগাল হেসে বললেন, “শাড়ি আমি ভালবাসি। আর কেনা? সে তো লস অ্যাঞ্জেলসের দোকানেই পেয়ে যাব।” সে দিন শাড়ি পরলেন কি নিজেই? এ বারের হাসিতে কি খানিক লাজুক ছোঁয়া! এক পল থেমে বললেন, “এখানে আমার বন্ধুরা আছেন। তাঁরাই সাহায্য করেছেন, এখানে ওখানে পিন করতে....।” কাঁধে ও কোমরের কাছে হাত দিয়ে দেখিয়েও দিলেন। এখানে সব চেয়ে ভাল আর সব থেকে খারাপ কী লাগল? এ শহরে এসে সকলেই যা বলেন, সেটাই শোনালেন অনিতা, “ভাল লেগেছে এখানকার আতিথেয়তা, আন্তরিকতা।” তবু নাছোড় প্রশ্ন, খারাপ কোনটা? নেহাত না বললে নয়, সে ভাবেই বললেন একটু হেসে, “এখানকার ট্র্যাফিক।” গোটা ঘরে একটু হাসি।
অনিতার ভারতে আসার আগের কিছু কথা জানালেন এ শহরে তাঁর এক বন্ধু। আসছেন কলকাতায়, নিজের শিকড়ের কাছে। অনিতাই চেয়েছিলেন, এ দেশের তাবড় বিজ্ঞানীদের সঙ্গে নয়, কথা বলবেন স্কুলের কচিকাঁচাদের সঙ্গে।
ছোঁবেন এ দেশের কিশোর মনগুলিকে। তবে শুধু চড়বড় করে ইংরেজি বলা শহুরে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে নয়। পিছিয়ে আছে যারা, শিক্ষার আলো যাদের কাছে পৌঁছয় বেশ খানিকটা আবছা হয়ে, তাদের প্রতি একটা বাড়তি টান কাজ করে এ মেয়ের মধ্যে। তাই আয়োজকদেরও সে ভাবেই বলে রেখেছিলেন তিনি। আর সে জন্যই বাসে করে চার-পাঁচ ঘণ্টার পথ বেয়ে পুরুলিয়া বাঁকুড়া, বর্ধমানের ছেলেমেয়েরাও সামনে পেয়েছে নাসার বিজ্ঞানীকে। অডিটোরিয়াম ছাপিয়ে ভিড় তাই বাইরে জায়ান্ট স্ক্রিনের সামনেও। শুধু মঙ্গলে মানুষের উপনিবেশ নয়, আরও একটি স্বপ্ন বুনে গেলেন বাঙালি মেয়েটি। তা হল, আরও বেশি করে মেয়েরা পড়ুক বিজ্ঞান-ইঞ্জিনিয়ারিং। নিছক চাকরির জীবন না বেছে সৃষ্টিশীল কিছু করুক।
তবে চিন্তা ছিল অনিতার। বাবা বাঙালি হলে কী হবে, তাঁর জন্ম তো ব্রিটেনে। বেড়ে ওঠা ও কাজকর্ম মার্কিন মুলুকে। যা তাড়াতাড়ি কথা বলেন! ইংরেজি না-বলতে পারা বাংলার ছেলেমেয়েরা বুঝবে তো সব? ভেবেছিলেন আয়োজকরাও। তাই তাঁর বক্তৃতার ভাবার্থ পরে বাংলায় বলা হল এ দিন। কিন্তু বক্তৃতা ও অন্যান্য পর্বের পরে ঘিরে ধরা ছেলেমেয়েরাই কিন্তু গলা তুলে জানাল অনিতাকে, “তোমার সব কথা বুঝেছি আমরা।” যারা বলল না, তারাও ঘাড় কাত করে পূর্ণ সমর্থন জানাল তাতে। আর এ বারই সব চেয়ে চওড়া হাসিটা ফুটে ওঠে অনিতার মুখে। আয়োজকদের দেওয়া উপহার-স্মারকগুলির চেয়েও ঢের দামি পুরস্কারটা বুঝি এই ছেলেমেয়েদের কাছ থেকেই পেয়ে গেলেন নাসার বিজ্ঞানী। প্রমাণ পেলেন স্বপ্নের কোনও ভাষা থাকে না। থাকে অনেক অনেক রং। তাই মহাকাশে আরও বড় পদচারণার স্বপ্ন বুনতে তাঁর অসুবিধা হয়নি মরক্কো বা ইথিওপিয়াতেও। নাসায় তাঁর কর্মযজ্ঞের মাঝে ফাঁক পেলেই তাই এ ভাবে বেরিয়ে পড়েন তিনি। না, ঘোরার নেশায় নয়। ছোটদের চোখে স্বপ্নের কাজল পরাতে। এই যে বারবার উল্লেখ করা হয়, লস অ্যাঞ্জেলসে ৯০০ সিসি-র বাইক হাঁকান তিনি। তা-ও কিন্তু রোমাঞ্চের জন্য নয়। ওখানকার গাড়িঘোড়ার ভিড়ে ওটাই দ্রুত ও সহজে গন্তব্যে পৌঁছনোর একমাত্র মাধ্যম তাঁর। শুক্রবার কথা প্রসঙ্গে এক বন্ধুকে জানিয়েছেন তিনি।
শনি ও রবিবার কলকাতায়
বন্ধু-স্বজনদের সঙ্গে কাটিয়ে চেন্নাই। তার পরে মুম্বই হয়ে ফিরবেন তাঁর স্বদেশে। এ দিনের সাংবাদিক বৈঠকে তো বটেই, পরে ঘরোয়া চায়ের আসরেও অবশ্য বারবার অনিতা জানিয়েছেন, “আবার আসব। বছর খানেকের মধ্যেই।”
ঘরের টান কি?
|
অবসরে কেপলার
সংবাদসংস্থা • নিউ ইয়র্ক |
অবসর নিল মহাকাশ দূরবীক্ষণ কেপলার। সৌর জগতের বাইরে পৃথিবী সদৃশ আর কোনও গ্রহ আদৌ আছে কি না তারই সন্ধানে ২০০৯ সালে কাজ শুরু করে নাসার এই দূরবীক্ষণ। মহাকাশ বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, গত চার বছরে প্রায় ১৩৫টি গ্রহের সন্ধান দিয়েছে কেপলার। চলতি বছরের মে মাসে চার চাকা বিশিষ্ট কেপলারের দ্বিতীয় চাকাটি অকেজো হয়ে পড়ে। একাধিক যান্ত্রিক ত্রুটিও ধরা পড়তে শুরু করে। শুরু হয় মেরামতির কাজ। তবে ইঞ্জিনিয়ারদের শত চেষ্টাতেও কেপলার তার কর্মক্ষমতা ফিরে পেল না। তাই সেটিকে বাতিল করল নাসা। |