|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
‘আমরাও বাড়ি যাব, মা-র কাছে যাব’
পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায় |
সন্ধেবেলা পুলিশের ভ্যান মেয়েগুলোকে হোমে নামিয়ে দিয়ে গেল। তখনও আট বছরের মীনাত্তা-র হাতে খিমচে ধরা কাদামাখা ছোট্ট প্লাস্টিকে বাঁধা অল্প মুড়ি। পাশে দাঁড়িয়ে বছর দশেকের অঞ্জুনারা। ডান হাতে নোংরা, পুঁচকে থলে। তাতে তিন-চারটে রংচটা ফ্রক, একটা জলের গেলাশ, একটা প্যাকেটে খানিক পচে যাওয়া ভাত আর শুঁটকি মাছ। দুর্গন্ধ। গন্ধ বাচ্চাগুলোর গায়েও। দশ-বারো দিন স্নান না-করা শরীরের গন্ধ। দিন-রাত হেঁটে দু’দুটো সীমান্ত পেরোনো একরত্তি পায়ের পাতাগুলো ফুলে, রক্ত জমে কালো। গায়ে জ্বর, চোখে আতঙ্ক। কাঁপতে কাঁপতে কয়েক পা চলেই পর-পর অজ্ঞান হয়ে গড়িয়ে পড়েছিল তিন জনই।
মীনাত্তাদের দেশ হারিয়ে গিয়েছে! মা-বাবা-দাদা-দিদি-দাদি-নানি কারও খোঁজ নেই। বিদেশি শহর, অজানা ভাষা, অপরিচিত লোকের মাঝখানে বাচ্চাগুলো এখনও বুঝতে পারেনি, ওদের নামের সঙ্গে ইতিমধ্যেই জুড়ে গিয়েছে একটা আন্তর্জাতিক বিশেষণ ‘স্টেটলেস’, দেশহারা।
ছয় বছরের মেয়ে জুনজুনাত্তর টানা কেঁদেই চলেছে। বুড়ো আঙুলটা মুখে পুরে অন্য হাতের আঙুলে মায়ের আঁচলের কোনা জড়িয়ে ঘুমোত সে। ঘুমের মধ্যেও চমকে ওঠে ছোট্ট মেয়ে। তখন তাকে জড়িয়ে ধরে তার বছর তেরোর দিদি সালোয়ারা। তার চোখে ভাসে পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন (পুরনো আরাকান) অঞ্চলে তাদের জ্বলন্ত গ্রাম। বাবা জাফর আলমের গলা কেটে দিল জলপাই রঙের পোশাক পরা লোকগুলো। বড়দিকে চুলের মুঠি ধরে কোথায় টেনে নিয়ে গেল। মা, দাদি আর দাদা ওদের নিয়ে ছুটল বাড়ির পিছনে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। গ্রাম জুড়ে তরোয়াল, বল্লম, বন্দুক, চিৎকার, আগুন, ধোঁয়া।
স্বাধীনতার ছেষট্টি বছর অতিক্রান্ত। কলকাতার অনতিদূরে উত্তর চব্বিশ পরগনা সীমান্তে সুদূর পশ্চিম-মায়ানমার থেকে আসা আট, দশ, বারো, চোদ্দোর রশিদা, জামিলা, শমিরা, নুরঙ্কিশ, সবুরা-রা একের পর এক ধরা পড়ছে বিএসএফের হাতে। একটা দেশের খোঁজে মা-বাবার হাত ধরে পাহাড়-জঙ্গল পার করে রওনা হয়েছিল তারা। জাতিদাঙ্গাদীর্ণ রাখাইন অঞ্চল থেকে পায়ে হেঁটে পালিয়ে প্রথমে বাংলাদেশ, ঠাঁই না মেলায় সেখান থেকে ফের ‘ইন্ডিয়া’। হানাহানিহীন এক টুকরো জমিতে আশ্রয় পাওয়ার স্বপ্ন ভারত সীমান্তে পৌঁছতে না পৌঁছতে ছিন্নভিন্ন। প্রতিরক্ষা, সীমান্ত আইন উল্লঙ্ঘনের মতো জটিল প্রসঙ্গ আবার কবে ‘মানবিক’ হওয়ার বোকামি করেছে? তাই মা-বাবার হাত ছাড়িয়ে ছোটদের তুলে দেওয়া হয় আলাদা ভ্যানে। ভয়ে-কান্নায় গড়াগড়ি খেতে থাকা বাচ্চাগুলোকে শিশু কল্যাণ কমিটির আদালতে পেশ করার পর তাদের গন্তব্য হয় নির্দিষ্ট হোম। সেখানেও আর এক প্রস্ত ছাড়াছাড়ি। বোন চলে যায় মেয়েদের হোমে, আর ভাই অনেক দূরে ছেলেদের হোমে। মা-বাবা ও অন্য প্রাপ্তবয়স্ক আত্মীয়েরা ইতিমধ্যে চলে গিয়েছেন কোনও সংশোধনাগারে। মাঝে সীমাহীন দূরত্ব আর অপেক্ষা।
সাতষট্টি বছর আগেকার ইতিহাস মনে পড়ে? সেই সদ্য পাওয়া স্বাধীনতা, ভাগ হওয়া দুটো দেশ, ভিটেমাটি হারানোর যন্ত্রণা, দাঙ্গা, খুন, আস্তানার খোঁজে পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরোতে গিয়ে ক্ষতবিক্ষত দেহ, মাঝপথে ছিটকে যাওয়া প্রিয়জনের জন্য রক্তাক্ত মন। গত চার-পাঁচ মাস ধরে প্রায় নিঃশব্দে ইতিহাসের এক পুনরাবৃত্তি ঘটছে। মানচিত্র বদলায়নি, দেশভাগ চলছে।
রাখাইনে জাতিদাঙ্গার শুরু গত বছরের মাঝামাঝি। জানুয়ারি থেকে তা মাত্রাছাড়া। সংখ্যালঘু ‘রহিঙ্গ্যা’দের উপর সংখ্যাগুরু সম্প্রদায় হামলা চালায়, পরোক্ষে মদত দেয় মায়ানমার সরকার। রাষ্ট্রপুঞ্জ বলেছে, ‘রহিঙ্গ্যাস আর ওয়ান অব দ্য মোস্ট পার্সিকিউটেড মাইনরিটিজ ইন দ্য ওয়ার্ল্ড।’
রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাবে ইতিমধ্যে ঘরছাড়া লক্ষাধিক রহিঙ্গ্যা। নিখোঁজ প্রায় বারোশো। সাতশোর বেশি খুন হয়েছেন। তিন হাজারের বেশি বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার অবশ্য হাত ঝেড়ে ফেলেছে। কারণ রহিঙ্গ্যারা সে দেশের ১৩৫টি স্বীকৃত জাতিগোষ্ঠীর অন্তভুর্ক্ত নয়, ফলে তাঁদের উপর হওয়া কোনও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে সরকার বাধ্য নয়। দাঙ্গায় ধ্বস্ত রহিঙ্গ্যারা আশ্রয়ের জন্য হন্যে হয়ে ছড়িয়ে পড়ছেন ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বাংলাদেশ এবং ভারতে।
মীনাত্তা, অঞ্জুনারা, সালোয়ারারা এই ভয়ার্ত দিশেহারা যাত্রার শরিক। ধরা পড়া রহিঙ্গ্যা বালিকাদের একের পর আনা হয়েছে নরেন্দ্রপুরের কাছে এলাচি গ্রামে সংলাপ-এর হোমে। ‘ইন্ডিয়া’ দেশটায় একটামাত্র জায়গার নাম জানে ওরা, জম্মু-কাশ্মীর। ওখানে নাকি অনেক আগে থেকেই রহিঙ্গ্যারা বসতি তৈরি করেছেন। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, জম্মু-কাশ্মীরে যাওয়ার পিছনে অন্য কিছু থাকতে পারে, এই আশঙ্কায় রহিঙ্গ্যা শরণার্থী সম্পর্কে দিল্লি ততই আরও স্পর্শকাতর হয়ে পড়েছে। |
|
মায়ানমার সরকার রহিঙ্গ্যাদের নাগরিক বলে স্বীকার করতেই রাজি নয়। ফলে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করার প্রশ্নই আসছে না। ওঁরাও নিজেদের গ্রামে ফিরতে চান না। ফেরা মানেই তাঁদের কাছে মৃত্যু। অঞ্জুনারা, জামিলা, সাবুরাদের মতো নাবালিকাদের অভিভাবকেরও খোঁজ নেই যাঁরা রেফিউজি কার্ড জোগাড় করে ওদের ছাড়িয়ে নিয়ে যাবেন। অতএব ওরা ‘স্টেটলেস’।
কিন্তু এত জটিলতা বোঝার বয়স তো হয়নি পুঁচকি মেয়েগুলোর। শয়নে-স্বপনে-জাগরণে একটাই আর্তি তাদের: ‘বাড়ি যাব, মা’র কাছে যাব।’ এই প্রথম কোনও ঈদ বাবা-মা-ভাইবোন ছাড়া কাটাল ওরা। অনেক সাধ্যসাধনা করেও নতুন জামা পরানো যায়নি অনেককে। সিমুইয়ের বাটি ছুঁয়ে দেখেনি বেশির ভাগই। হোমের লাল মেঝের চাতালে বসে দোভাষী নিয়ে কথা হচ্ছিল ওদের সঙ্গে। আকারে ইঙ্গিতে চোখের জলে আর চট্টগ্রামীয় বাংলা-বার্মিজ মেশানো ভাষায় আপ্রাণ নিজেদের যন্ত্রণা বোঝানোর চেষ্টা করছিল ৬ থেকে ১৫ বছরের হঠাৎ পরিণত হয়ে যাওয়া মেয়েগুলো।
সাপবাজার গ্রামের তেরো বছরের নুরকলিমা প্রায় পাঁচ মাস হল এই হোমে এসেছে। বাবা গ্রামে মাটি কাটার কাজ করতেন। সব্জি বিক্রি করতেন মা। অভাবের সংসার, তবু শান্তি ছিল। নুরকলিমা বলে, ‘রহিঙ্গ্যাদের মধ্যে মেয়েরা তেমন স্কুলে যায় না... ঘরের কাজ করতাম... তার পর হামলা শুরু হল। প্রথমে সারারাত বাড়িতে পাথর ছুড়ত ওরা। ভয়ে মাটির ঘরের দরজার উপর কাঁটাগাছ আর পাথর চাপা দিয়ে সারা রাত জেগে থাকতাম। এক দিন পুলিশ এসে গ্রাম জ্বালিয়ে দিল। আমরা পালালাম। চার দিন না-খেয়ে তিনটে পাহাড় আর ঘন জঙ্গল পার হলাম আমি মা বাবা, দাদা, দিদি, বোন আর ছোট ভাই... বাংলাদেশ পৌঁছে কুতুফালমে চাচার বাড়ি দু’দিন থাকলাম। ইন্ডিয়া যাব বলে সীমান্তে বাসে ওঠার কথা ছিল। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে মা আর বাবা ছোট ভাই-বোন দুটোকে নিয়ে উঠতে পেরেছিল। আমি, দিদি নুরনার আর দাদা হারুলামি পারলাম না। বিএসএফ ধরে নিল। দিদি-দাদাকে জেলে নিয়ে গেল আর আমাকে এখানে এনে রাখল।’
ক’মাসেই নুরকলিমার বাংলা বেশ পরিষ্কার। সদ্য-পরিচিত সাংবাদিকের হাত দু’টো জড়িয়ে ধরে সে বলে, ‘এই হোম থেকে কিছু দিন আগে চারটে রহিঙ্গ্যা মেয়ে ছাড়া পেয়েছে। আমাদের গ্রামেরই ছিল। ওরা জানিয়েছে, ওদের বাবা-মা আর আমার বাবা-মা সবাই জম্মু-কাশ্মীরে আছে। আমি ওখানে যাব। তুমি আমাকে নিয়ে যাও দিদি। মাকে ছেড়ে আর বেশি দিন থাকলে আমি মরে যাব।’ সামনে বসে থাকা ছোট্ট ভিড়টা ফুঁপিয়ে ওঠে, ‘আমরাও বাড়ি যাব, মা-র কাছে যাব।’ এগারো বছরের মাজুমা জামার হাতায় চোখ মুছে কাছে উঠে আসে। বলে, ‘সবাই বলছে, ইন্ডিয়ায় আমাদের থাকতে দেবে না। এটা নাকি অন্য দেশ। কিন্তু আমাদের তো গ্রাম থেকে খেদিয়ে দিয়েছে, আমরা তবে কোথায় যাব? ইন্ডিয়ায় থাকতে পারব না কেন?’
ঝপ করে মনে পড়ে যায় সাদাত হোসেন মান্টো-র ‘টোবা টেক সিং’ গল্পের বিষণ সিংহকে। বিষণ বুঝতেই পারেন না, তাঁর জন্মস্থান টোবা টেক সিং তো ভারতেই ছিল, সেটা হঠাৎ পাকিস্তান হয়ে গেল কী করে? সদ্য স্বাধীন পাকিস্তান সরকার বিষণকে ভারতে ফেরত পাঠাতে চায়, দু’দেশের কাঁটাতারের বেড়ার মাঝখানে নো-ম্যানস ল্যান্ডে শুয়ে পড়ে তিনি বলেন, ‘এটাই আমার জমি, আমার টোবা টেক সিং।’ চোখের সামনে বিষণ, মাজুমা, নুরকলিমা মিলেমিশে যেতে থাকে।
একটু পিছনে চুপ করে বসেছিল দশ বছরের আমাতুল্লা। গায়ে জ্বর, গাল দুটো তপ্ত, লাল। ডাক্তারবাবুরা জানিয়েছেন, আতঙ্কে, অবসাদে আর চিন্তায় ছোট্ট মেয়ের সুগার সাড়ে পাঁচশো হয়ে গিয়েছে। সব সময় চুপ করে শুয়ে থাকে সে। অনেক কষ্টে কয়েকটা বাক্য বার করা গেল তার মুখ থেকে। ‘বাবাকে ওরা মেরে ফেলল। ছোট ভাই ছিল দুটো। একটা পাঁচ বছরের, একটা সাত। ওরা কোথায় জানি না। ওদের কথা মনে পড়লে আমার খুব কান্না পায়।’
আমাতুল্লার কথা শুনেই দু’হাতে মুখ ঢেকে হাউহাউ করে কেঁদে উঠল সবুরা। বয়স ১৪। বিয়ে হয়ে গিয়েছিল গ্রামেরই সাবির আহমেদের সঙ্গে। এক দিন রাতে হামলাকারীরা গ্রামে এল। বড়দের পাশাপাশি ছোট ছোট শিশুদের টেনে গলা কেটে নদীর জলে ফেলে দিতে লাগল। সবুরার চোখের সামনে গলা কেটে খুন করল তার বাবাকে। বরকেও সে দিনের পর থেকে দেখতে পায়নি সবুরা। মা, দুই ভাই, চাচা-চাচির সঙ্গে পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পাহাড়ি জঙ্গল পেরিয়ে পালিয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশ। সেখান থেকে ভারত সীমান্ত। ধরা পড়ে নিরাপত্তাকর্মীদের হাতে। ছিটকে যায় সবাই। হোমে আসার কিছু দিন বাদে সবুরা টের পায় সে অন্তঃসত্ত্বা। তার সামনে এখন আদ্যন্ত অন্ধকার। কোনও দিন ছাড়া পাবে কি না জানে না, ছাড়া পেলেও সন্তানকে নিয়ে কোথায় যাবে জানে না। |
|
|
|
|
|