স্বাধীনতা প্রাপ্তির ৬৬ বছর পরে কেমন আছেন ভারতের সংখ্যালঘুরা, বিশেষত তাহার বৃহত্তম সংখ্যালঘু সম্প্রদায়? তাঁহারা যে বৈষম্য ও বঞ্চনার শিকার, তাহা উপলব্ধি করিয়াই সাত বছর আগে বিচারপতি সাচারের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠিত হয় সংখ্যালঘুদের হাল-হকিকত জানিতে। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, দেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের অবস্থা দলিতদের চেয়েও খারাপ। আপাতদৃষ্টিতে কেন্দ্রে ও রাজ্যে রাজ্যে সরকারকে নড়িয়া বসিতে দেখা যায়। শিক্ষায় ও কর্মসংস্থানে অধিক সংখ্যায় মুসলিমদের যোগদানের বন্দোবস্ত করার প্রতিশ্রুতি বিজ্ঞাপিত হয়। কিন্তু সাত বছর পরেও দেখা যাইতেছে, ওই প্রতিশ্রুতি পালিত হয় নাই। জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমরা সরকারি চাকুরির মাত্র ৬ শতাংশের ভাগীদার। আমলাতন্ত্রে এই হার মাত্র আড়াই শতাংশ। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের পক্ষে ইহা কোনও শ্লাঘার বিষয় নয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের সংখ্যালঘু বিষয়ক দফতরের এক সমীক্ষায় বলা হইয়াছে, সংখ্যালঘু আবেদনকারীদের মধ্যে যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীর অভাবই ব্যাঙ্ক, রেলওয়ে, সরকারি সংস্থা ও আধা-সামরিক বাহিনীতে তাঁহাদের অনুপস্থিতির কারণ। দাবিটি সর্বাংশে মিথ্যা, এমন বলা যাইবে না। অন্তত যে-সব চাকুরিতে উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন, তাহাতে সংখ্যালঘুদের নিযুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ তাঁহাদের মধ্যে যোগ্য ব্যক্তির অনুপাত তুলনায় কম। কিন্তু আধা-সামরিক বাহিনীর জওয়ান কিংবা পুলিশ কনস্টেবলের কাজে নিযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্যতার কোনও অভাব হওয়ার কথা নয়। অথচ জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় আধা-সামরিক বাহিনীর মাত্র ৩.২ শতাংশ মুসলিম। সরকারি সমীক্ষায় ইহার কারণ হিসাবে মুসলিমদের তরফে এই ধরনের কাজে যোগ দিতে অনাগ্রহের কথা বলা হইয়াছে। কিন্তু এই অনাগ্রহের পিছনেও কি অন্যতর কারণ থাকা সম্ভব? তাঁহাদের প্রতি নিয়োগকর্তাদের বৈষম্য ও বিমাতৃসুলভ মনোভাব, এই সব কাজে যোগ দিতে নিরুৎসাহিত করার প্রবণতা বা যোগদানের পথ বন্ধ করিয়া দেওয়ার কৌশলী প্রক্রিয়া? সমীক্ষা নিরুত্তর।
লক্ষণীয়, সরকারি চাকুরিতে প্রার্থী বাছাইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে অন্তত এক জন সংখ্যালঘুর উপস্থিতির যে নিদান সাচার কমিটির সুপারিশ ছিল, তাহা প্রায়শই লঙ্ঘিত হয়। ফলে নিয়োগ-প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা সম্পর্কে প্রশ্ন ওঠে। পাশাপাশি, সন্দেহ করিবার যথেষ্ট কারণ আছে যে, সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে সমাজে বহুলপ্রচলিত সংশয় ও বিরাগ দেশের সরকারি পরিসরে নিয়োগপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে, পদোন্নতির সম্ভাবনা ব্যাহত করে। এই পরিস্থিতি হইতে উত্তরণের পথ হিসাবে রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশন চাকুরিতে মুসলিমদের জন্য কোটা সংরক্ষণের নিদান দিয়াছিল। তাহা অনুসরণ করিয়া দক্ষিণ ভারতের কয়েকটি রাজ্যে এবং পশ্চিমবঙ্গেও অনগ্রসরদের কোটা হইতে মুসলিমদের জন্য কিছু আসন সংরক্ষণের ব্যবস্থা হয়। তাহাতে সংখ্যালঘুর ক্ষমতায়ন ঘটিয়াছে, তাঁহারা আগের তুলনায় অধিকতর সুযোগ ও মর্যাদা পাইতেছেন, এমন বলা যাইবে না। ইতিমধ্যে লোকসভা নির্বাচন আসিতেছে। সংখ্যালঘুর উন্নয়নের জন্য রাজনীতিকদের দরদ ব্যক্ত করার এমন উপলক্ষ আর হয় না। আবার, সংখ্যালঘু তোষণের অভিযোগে বিষাক্ত রাজনীতির অনুশীলনের সুযোগও সমাগত। আশঙ্কা হয়, সংখ্যালঘুরা সেই তিমিরেই থাকিয়া যাইবেন। |