কয়লার আঁচে জ্বলে যায় প্রান্তিক জীবনও
য়লা পোড়ে, শহরে-গাঁয়ে ঘরে-ঘরে বিদ্যুতের বাতি জ্বলে। আর তার নীচেই সঙ্গোপনে জমা হয় কালিমাখা জীবনের কাহিনি।
এ রাজ্যের মোট বিদ্যুতের ৭৫ শতাংশই তৈরি হয় কয়লা পুড়িয়ে। বর্ধমান, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ায় ছড়িয়ে রয়েছে বহু আছে স্পঞ্জ আয়রন কারখানাও, যারা মূলত নিম্নমানের কয়লা ব্যবহার করে এবং দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধির তোয়াক্কা করে না। কয়লার ছাইয়ে আশপাশের গ্রামে চাষ-আবাদ প্রায় বন্ধ, পুকুরের জল নষ্ট, গরু ছাগলের খাওয়ার মতো ঘাস পর্যন্ত নেই।
গোটা দেশেও অর্ধেকের বেশি বিদ্যুতের জোগান আসে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি থেকে। তার জন্য যে কয়লা লাগে তার ১৫ শতাংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এর পরেও অবশ্য নিয়মিত গণমাধ্যমে আলোচনা হয়, কয়লার অভাবে দেশে পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাচ্ছে না। কিন্তু কয়লা খনির কারণে যে বিপর্যয় নেমে আসছে তা নিয়ে প্রায় কোনও কথাই হয় না। খনিগুলো যেন অভিশাপের মতো। কয়লা ও খনির রাজনীতি তথা অর্থনীতি নিয়েই এ বার ‘কোল কার্স’ নামে একটি তথ্যচিত্র তৈরি করেছেন পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা।
মাটি ফেটে ধোঁয়া বেরতে দেখা রোজকার অভ্যেস।—ফাইল চিত্র।
পরঞ্জয়ের ছবিতে অবশ্য স্পঞ্জ আয়রনের দূষণের কথা সরাসরি নেই। কিন্তু রয়েছে সেই দরিদ্র আদিবাসীদের কথা, কয়লাখনির জন্য যাঁরা জল-জঙ্গল-জমি-ভিটের অধিকার হারিয়েছেন। নব্বইয়ের দশকে হওয়া বিশ্বব্যাঙ্কের একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, ১৯৪৭ সাল থেকে ওই সময় পর্যন্ত শুধু কয়লাখনির জন্যই ৪৫ লক্ষ মানুষ উৎখাত হয়েছেন। তাঁরা না পেয়েছেন জমি, না পেয়েছেন ক্ষতিপূরণ। কয়লার অবৈজ্ঞানিক খনন বন্ধ করতে এবং শ্রমিকদের অমানবিক অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে ১৯৭০ সালে কয়লাখনি জাতীয়করণ হয়। কিন্তু তাতেও অবস্থা বদলেছে সামান্যই।
দেশের বেশির ভাগ কয়লাখনি হতদরিদ্র আদিবাসী এলাকায়। কিন্তু সেই সব প্রান্তিক ভূমিপুত্রদের জীবনযাপনে যে বিশেষ উন্নতি হয়নি, বরং উল্টোটাই বেশি ঘটেছে, তার ইঙ্গিত রয়েছে কেন্দ্রীয় পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশের বক্তব্যে। তাঁর কথায়, “আমি প্রশাসন এবং সংসদের সদস্য হিসেবে বলছি, রাজ্য বা কেন্দ্রে যে রঙেরই সরকার আসুক না কেন আমরা সবসময় খনিজ সম্পদের কথা ভাবি। ভুলে যাই ভুক্তভোগী আদিবাসীদের কথা।”
সিঙ্গরৌলী নামে একটি এলাকার বাসিন্দা ও আদিবাসীদের কথা শুনিয়েছেন পরঞ্জয়। উত্তরপ্রদেশের সীমানা ঘেঁষা মধ্যপ্রদেশের ওই এলাকা এখন দেশের ‘বিদ্যুৎ হাব’। ভারতে কয়লাচালিত তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো যত বিদ্যুৎ উৎপাদন করে তার ১০ শতাংশ, ১৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন হয় সেখানেই। সরকার চাইছে উৎপাদন দ্বিগুণ করতে। অথচ যাঁদের অরণ্য ধ্বংস করে বাতাস-নদী দূষণে ভরিয়ে দিয়ে, জমি দখল করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো তৈরি হল, সিঙ্গরৌলীর সেই গরিব মানুষগুলো পেল না কিছুই। পরঞ্জয় বলেন, “কেবল আমি নই, ‘গ্রিন পিস’ আন্দোলনের কর্মীরাও মনে করেন অরণ্যের অধিকার সংক্রান্ত আইন হয় মানা হয়নি, নয়তো যথাযথ ভাবে কার্যকর করা হয়নি।” যা স্বীকার করে নেন আদিবাসী দফতরের মন্ত্রী কিশোরচন্দ্র দেও-ও।
‘কোল কার্স’ ছবির এক দৃশ্য। (তথ্যচিত্রের দৃশ্যের স্থিরচিত্রটি পরিচালকের সৌজন্যে প্রাপ্ত)
আসলে সিঙ্গরৌলী থেকে ঝরিয়া পর্যন্ত আদিবাসীদের বঞ্চনার একই বৃত্তান্ত। কেবল ক্ষতিপূপণই নয়, প্রতিশ্রুতি মতো বিদ্যুৎকেন্দ্রে কাজও দেওয়া হয়নি তাঁদের। কিছু মুটে, দিনমজুর আর অদক্ষ শ্রমিক ছাড়া স্থায়ী কোনও কাজ জোটে না। পরঞ্জয়ের ছবি দেখায়, বাংলা, ঝাড়খণ্ড, ওড়িশা, ছত্তীসগঢ় বা মধ্যপ্রদেশের সেই সব ভিটে-জমি-অরণ্যের অধিকার হারানো আদিবাসী মানুষেরা কী ভাবে বেঁচে আছেন। কুড়িয়ে আনা মহুয়া ফুল থেকে মদ তৈরি করে তাঁদের জীবন চলে। অথচ হতদরিদ্র মানুষগুলোর পায়ে পা মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জীবনের গান গাওয়া শেষ হয় না।
তথ্যচিত্রের প্রথম পর্বে রয়েছে কয়লা কেলেঙ্কারির অতি সাম্প্রতিক বৃত্তান্ত। দেশে মুক্ত বাজার অর্থনীতি আমদানির পরে এমন সব সংস্থাকে কয়লা খননের অনুমতি দেওয়া হয়েছে, যাদের খনির কাজে কোনও অভিজ্ঞতা নেই। ১০.৭ কোটি টাকার ওই দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সমেত শাসকদল, এমনকী বিরোধী দলেরও তাবড় নেতারা। তা নিয়ে বিস্তর হইচই। কিন্তু অন্ধকারে থেকে গিয়েছেন জল-জমি-জঙ্গলের অধিকার হারানো লক্ষ লক্ষ আদিবাসী। ছবিটি অবশ্য সমাধানের কথা বলেনি। কিন্তু দু’টি স্পষ্ট সুপারিশ রয়েছে এক, ক্ষতিগ্রস্তদের জল-জমি-জঙ্গলের অধিকারের বিষয়টা মেনে নিয়ে আইন মেনে ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। দুই, কয়লার ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য জল, বাতাস, সূর্যালোক থেকে অনেক বেশি পরিমাণে অপ্রচলিত বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর জোর দিতে হবে। তা না হলে ‘কয়লার অভিশাপ’ থেকে মুক্তি নেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.