খবরের শিরোনাম থেকে সেলুলয়েডের পর্দায় এসেছেন ঠিকই। কিন্তু মানুষটা আর নেই!
সিনেমার বরুণ বিশ্বাসের দিকে অপলক তাকিয়ে বাস্তবের বরুণ বিশ্বাসের মা গীতাদেবী। ছলছলে
চোখে শুধু বললেন, “বইয়ে কি আর সবটা এক রকম হয় কখনও! কিন্তু আমার ছেলের নাকটাও অমন টিকোলোই ছিল!”
মিল আরও আছে। আর পাঁচটা ফিল্মে যেমন হয়ে থাকে, ছবির গোড়ার ঘোষণাটা তেমন নয়। ‘সব চরিত্র কাল্পনিক’ বলে সেই নিয়মমাফিক সতর্কতার দেখা নেই। বরং বলা হয়েছে, ‘যে সত্য ঘটনা নিয়ে এই গল্প শুরু, সেই ঘটনায় নায়ক বরুণ বিশ্বাস বহু মানুষের কাছে এক আদর্শ।’
এক বছর আগে আততায়ীর গুলিতে নিহত সুটিয়ার প্রতিবাদী নায়ক বরুণ বিশ্বাসের ছায়ায় তৈরি এই ছবি নিয়ে মুক্তির আগে থেকেই প্রচুর জল্পনা। ৫ জুলাই বরুণ বিশ্বাসের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে সুটিয়ায় গিয়েও ‘প্রলয়’ ও বরুণের যোগসূত্রটুকু মনে করিয়ে দেন রাজ। ছবির মুক্তির দিনে বরুণের মা-বাবা-দাদা-দিদিদের সঙ্গে সুটিয়া থেকেই দক্ষিণ কলকাতার প্রিমিয়ার শোয়ে হাজির জনা ৭০ গ্রামবাসী। বরুণের প্রতিবাদী-মঞ্চের সহযোদ্ধা ননীগোপাল পোদ্দার, পরিমল বিশ্বাসেরা ছবি দেখে খুবই আপ্লুত।
তবে বরুণ বিশ্বাসের কিছু ঘটনা বাদ দিয়ে বাকি অংশটা যে কাল্পনিক তা জানাতে ভুলছেন না পরিচালক রাজ চক্রবর্তী। কিন্তু তার জন্য বরুণের কাহিনির সঙ্গে এই ছবি বেখাপ্পা বলে মনে হয়নি সুটিয়াবাসীর। কলকাতায় আগে কখনও সিনেমা দেখেননি দূর মফস্সলের এই বাসিন্দারা। কিন্তু পর্দায় বরুণকে দেখার টানেই দল বেঁধে এত দূর উজিয়ে এসেছেন ওঁরা। |
বাস্তবের সাড়া-ফেলা কোনও ঘটনা নিয়ে তৈরি সিনেমা অবশ্য অনেক সময়ই এমন অভিঘাত তৈরি করে থাকে। বারাসতে দিদি রিঙ্কুকে বাঁচাতে গিয়ে ভাই রাজীবের খুন হওয়ার ঘটনাকে মনে রেখে তৈরি ছবি ‘আটটা আটের বনগাঁ লোকাল’ নিয়েও বছরখানেক আগে আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। এ রাজ্যে ইদানীং কালের ধর্ষণের ঘটনা-প্রসঙ্গ নিয়ে অবশ্য এখন কথা বলতে চান না সেই ছবির নায়ক তাপস পাল। তবে বললেন, “খুবই প্রাসঙ্গিক ছবি ছিল। এখন মুক্তি পেলেও ছবিটা দারুণ চলত!”
অতীতে ভাওয়াল সন্ন্যাসীর কাহিনি নিয়ে উত্তমকুমারের ‘সন্ন্যাসী রাজা’, এ দেশে টেস্টটিউব বেবির জনক সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে তপন সিংহের ‘এক ডক্টর কি মওত’ বা দেবশ্রী-অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে ‘অন্তর্ধান’ বাস্তব থেকেই তার উপাদান সংগ্রহ করেছে। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দহন’-এর নেপথ্যেও ছিল কলকাতার রাজপথে এক তরুণীর উপরে নির্যাতনের সত্য ঘটনা। কিন্তু সেই সব বাস্তব-আশ্রয়ী ছবির থেকে ‘প্রলয়’কে কিছুটা আলাদা বলেই মনে করছেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের শিক্ষক মৈনাক বিশ্বাস। তাঁর কথায়, “একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে এত তাড়াতাড়ি সেটা সেলুলয়েডে উঠে আসছে, এমন বাংলা ছবির কথা কিন্তু মনে পড়ছে না।”
সময়ের এই কম ব্যবধানটা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মৈনাকের মতে, প্রকৃত ঘটনা ও সিনেমার তৈরির সময়ের ব্যবধানে অনেক সময় বিতর্ক মিইয়ে যায়। যেমন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোনও ঘটনা নিয়ে আজ ছবি হলে বিষয়টা হয়তো তত স্পর্শকাতর হবে না। এই প্রসঙ্গেই উঠে আসছে অনুরাগ কাশ্যপের ছবি ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’র উদাহরণ। ’৯৩ সালের মুম্বই বিস্ফোরণের পটভূমিতে তৈরি ছবিটি মুক্তির তোড়জোড়ের সময় বিস্ফোরণ-মামলায় অভিযুক্তদের বিচার চলছিল। ছবিটি সেই বিচারে প্রভাব ফেলতে পারে বলে একটি মামলার জেরে ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’র মুক্তি বছর চারেক পিছিয়ে গিয়েছিল।
একেবারেই হালফিলের ঘটনা নিয়ে ছবি তৈরির এই ট্রেন্ডটা বর্তমানে বলিউডে বেশ জনপ্রিয়। জেসিকা হত্যা মামলা নিয়ে ‘নো ওয়ান কিলড জেসিকা’ হইচই ফেলেছিল। শীঘ্রই মুক্তি পাবে অণ্ণা হজারের আন্দোলনের ছায়ায় তৈরি প্রকাশ ঝা-র ‘সত্যাগ্রহ’ বা মুম্বইয়ে কসাবের আইনজীবী, নিহত শহিদ কাজমিকে নিয়ে ছবি ‘শহিদ’।
তবু এ সব ছবির মধ্যে প্রকৃত চরিত্রদের খুঁজতে যাওয়াটা ঠিক হবে না বলেই মনে করেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম স্টাডিজের আর এক শিক্ষক সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, “বাস্তবের আদলে সিনেমা সাধারণত কল্পকথারই নির্মাণ করে।” সিনেমা ও বাস্তবের দুই বরুণের মধ্যে ফারাকটা পর্দার ‘বরুণ’ পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়ও মনে করিয়ে দিচ্ছেন। পরম বলছিলেন, “বরুণ কেমন ছিলেন, খবরের কাগজ-টাগজ ঘেঁটে তা কিছুটা বোঝার চেষ্টা করেছিলাম। তবে আমি প্রধানত স্ক্রিপ্টটাই অনুসরণ করার চেষ্টা করেছি!” আর রাজের কথায়, “বরুণ আমার ছবির প্রেরণা। কিন্তু এটা হুবহু বরুণের ঘটনা নয়।” ‘দহন’-এ নির্যাতিতার ভূমিকায় অভিনয় করা ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তও বলছেন, বাস্তবের মেয়েটির সঙ্গে তাঁর দেখা হয়নি। “পরিচালকের নির্দেশ ও চিত্রনাট্য মেনেই আমি ওই মেয়েটির যন্ত্রণা বোঝবার চেষ্টা করেছিলাম।” আর ‘দহনে’র গল্প যে ঘটনা নিয়ে, সেই ঘটনায় বাস্তবের প্রতিবাদিনী অনন্যা চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, ছবি বা উপন্যাসের ঝিলিকের সঙ্গে তাঁর নিজের মিল যৎসামান্য। একদা সাংবাদিক, এখন সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের মাস কমিউনিকেশন্স-এর শিক্ষক অনন্যা জানান, নির্যাতিতা তরুণীর সঙ্গী পুরুষটিও খুবই সংবেদনশীল মানুষ ছিলেন। মেয়েটির বিপদে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। ছবিতে দেখানো হয়েছিল তার ঠিক উল্টো। ‘দহনে’ পজিটিভ চরিত্র নেগেটিভ হয়ে গিয়েছিল! ‘প্রলয়’-এ বরুণকে নিয়ে সে প্রশ্ন নেই। বরং তাঁর নায়কত্ব বহু গুণে বাড়বে বলেই আশা করছেন নির্মাতারা। বিশেষজ্ঞদের মতও তাই-ই বলছে। “হয়তো এই ছবির মধ্যে দিয়েই বরুণ আরও বেশি মাত্রায় কিংবদন্তি হয়ে উঠবেন”, বলছেন সঞ্জয়। অনেক বেশি ‘লার্জার দ্যান লাইফ’!
হলেই বা ক্ষতি কী? “বরুণকে নিয়ে ছবি করাই তো সেই জন্য! যাতে বরুণ আরও বহু মানুষের জীবনে আদর্শ হয়ে ওঠেন, অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন” রাজ চক্রবর্তীর এই স্বপ্ন সফল হবে কি না, সেটা অবশ্য সমাজই বলবে! |