পায়ুদ্বারে রাখা সোনার বিস্কুট!
কার্বন ও প্লাস্টিক দিয়ে মোড়া একটি প্যাকেট। সেটির উপর জেলির মতো পদার্থ (লুব্রিকেন্ট) লাগিয়ে মসৃণ করে তা ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে কন্ডোমের মধ্যে। সেই কন্ডোম আবার জেলি লাগিয়ে নরম করে জোর করে পায়ুদ্বারের ভিতর ঢুকিয়ে নিয়ে উড়ে যাচ্ছেন যাত্রী। তার পর গন্তব্যে পৌঁছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে বেরিয়ে আসছেন বাইরে।
এই অভিনব পদ্ধতিতে সোনার বিস্কুট পাচারের বেশ কয়েকটি ঘটনা পরপর ঘটে গিয়েছে কলকাতা বিমানবন্দরে। গত জুন মাসে (১৩,১৯,২৩ তারিখ) এই ভাবে সোনা পাচার করতে গিয়ে তিন জন বিমানযাত্রী ধরাও পড়েছেন। তিন জনেই এসেছিলেন পশ্চিম এশিয়ার দেশ থেকে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, পায়ুদ্বারে ওই প্যাকেট-সহ কন্ডোম ঢোকানোর জন্য যন্ত্রনা এড়াতে ইঞ্জেকশন নিতে হয়। তবে এই
পদ্ধতি বার বার অবলম্বন করলে ভবিষ্যতে বড়সড় কোনও রোগও দেখা দিতে পারে।
কিন্তু কেন এত কষ্টসাধ্য পথে সোনা পাচার করতে মরিয়া চেষ্টা?
শুল্ক অফিসারদের মতে, সোনা আমদানির উপরে এক ঝটকায় অনেকটা শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে যেখানে শুল্কের পরিমাণ ছিল ১%, গত ৫ জুন সেটাই বেড়ে হয়েছে ৮%। এর ফলে এক কিলোগ্রাম সোনা আমদানি করতে এখন ২ লক্ষ টাকা অতিরিক্ত লাগছে। ফলে সোনার আমদানি অনেকটা কমে গিয়েছে। আর এই কারণেই চোরাপথে বেশি করে ঢুকছে সোনা।
কেন্দ্রীয় রাজস্ব সচিব সুমিত বসু বলছেন, “সোনার চোরাপাচার রুখতে শুল্ক দফতর যথেষ্ট তৎপর। গোয়েন্দাদেরও সতর্ক থাকতে বলা হচ্ছে।” আগাম খবরের ভিত্তিতে চোরাচালানকারীদের বিষয়ে সতর্ক হচ্ছেন শুল্ক অফিসারেরা। ধরা পড়ছে যাত্রী। আবার নির্দিষ্ট খবর না থাকা সত্ত্বেও ধরা পড়ছে কেউ কেউ। যেমন শ্রীলঙ্কার মহম্মদ রিয়াজ। গত জুনে দুবাই থেকে কলকাতা বিমানবন্দরে নামার পরে দেখা যায়, তার সঙ্গে রয়েছে মাত্র একটি হাতব্যাগ! সন্দেহ হওয়ায় ভাল করে তল্লাশি করতে গিয়েই ওই যুবকের পায়ুদ্বারে লুকনো দেড় কিলোগ্রাম সোনা উদ্ধার করেন শুল্ক অফিসারেরা।
এই সব ঘটনার পরে কলকাতা বিমানবন্দরে সোনা-চোরাচালান একশো শতাংশ বন্ধ হয়ে গিয়েছে বলে আর দাবি করছে না শুল্ক দফতর। অফিসারদের একাংশের মতে, তাঁদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়িয়ে কিছু
লোক সফল ভাবে সোনা পাচার করতে সক্ষম হচ্ছে। এক অফিসার বলেন, “পশ্চিম এশিয়া থেকে
সোনা কিনে আনার প্রবণতা বেড়েছে সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে। এখন এক জন পুরুষ যাত্রী ৫০ হাজার টাকার এবং এক জন মহিলা যাত্রী ১ লক্ষ টাকার সোনার গয়না কিনে আনতে পারেন। এ জন্য তাঁকে অতিরিক্ত শুল্ক দিতে হয় না। এর সুযোগ নিতে সাধারণ যাত্রীরাও অনেক সময় লুকিয়ে একটু বেশি সোনা নিয়ে আসছেন। আমরা জরিমানা নিয়ে ছেড়ে দিচ্ছি।”
কিন্তু কেন এই শুল্কবৃদ্ধি?
দিল্লির কর্তারা জানিয়েছেন, ডলারের তুলনায় টাকার দাম পড়ে গিয়েছে। এর অর্থ, রফতানি করে দেশের যে পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা আয় হচ্ছে, আমদানি করতে গিয়ে তার থেকে বেশি বিদেশি মুদ্রা বেরিয়ে যাচ্ছে। তাই আমদানি-খরচ কমাতে চাইছে কেন্দ্র। সাধারণত তেল, কয়লা এবং সোনা আমদানি করতেই বেশি ডলার ব্যয় হয় ভারতের। এর মধ্যে আবশ্যিক পণ্য হিসাবে তেল ও কয়লা আমদানি বন্ধ করা সম্ভব নয়। তাই কোপ পড়েছে সোনার উপরে। এই বহুমূল্যের পণ্য আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে শুল্ক বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
এবং সরকারের এই উদ্দেশ্য কিছুটা হলেও সফল বলে দাবি দিল্লির কর্তাদের। শুল্ক বাড়ানোর পরে সোনার আমদানি কমেছে। কতটা? বাণিজ্য মন্ত্রকের ডিরেক্টর জেনারেল (ফরেন ট্রেড) অনুপ পূজারি বলেন, “গত মে মাসে দেশে ৮৪০ কোটি ডলারের সোনা-রুপো আমদানি হয়েছিল। জুন মাসে তা এক ধাক্কায় ২৪৫ কোটি ডলারে নেমে এসেছে।” মন্ত্রকের বক্তব্য, বিদেশ থেকে প্রধানত সোনার বিস্কুট বা বাট আমদানি করা হয়। পশ্চিম এশিয়া, ইংল্যান্ড, সুইৎজারল্যান্ড থেকে ভারতে সোনা আমদানি করেন নীলেশ পারেখ।
তাঁর কথায়, “জুনের পরে আমদানি কমে এক-তৃতীয়াংশ হয়ে গিয়েছে। তার মানে কিন্তু সোনা এক-তৃতীয়াংশ ঢুকছে, এমন মনে করার কোনও
কারণ নেই। চোরাপথেই ঢুকছে অনেকটা অংশ।”
রাজ্যের স্বর্ণশিল্পী বাঁচাও কমিটির সভাপতি বাবলু দে-র মতে, “যা ধরা পড়ছে তা সামান্য একটি সংখ্যা। আসছে আরও বেশি।” সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে ভারতে সোনা ঢোকার সময়ে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছেন দুই ব্যক্তি। এক জন ত্রিপুরার গোকুলনগরে, অন্য জন শিলচরের করিমগঞ্জে বাসিন্দা। সোনা পাচারের প্রবণতা যে বাড়ছে, তা বাহিনীর এডিজি বংশীধর শর্মাও স্বীকার করে নিয়েছেন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সরকারি খাতায় সোনার আমদানি কমলেও আসলে চাহিদা কমেনি। চাহিদা না কমলে চোরাপথে জোগানও বন্ধ হবে না। শেয়ার বাজার টলোমলো। মূল্যবৃদ্ধির হার যথেষ্ট চড়া। তাই ধনী থেকে মধ্যবিত্ত ব্যাঙ্কে টাকা জমানো বা শেয়ার বাজারে টাকা খাটানোর থেকে সোনাতেই বিনিয়োগ করতে বেশি ভরসা পাচ্ছেন।
চোরাচালানের জন্য যেটুকু রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে, তা অবশ্য মেনে
নিতে রাজি কেন্দ্র। কারণ, তাদের
কাছে ডলারের তুলনায় টাকার দাম বাড়ানো এই মুহূর্তে অনেক বেশি জরুরি কাজ। |