ফ্যাতাড়ুদের মরণ নেই। রাষ্ট্রের সকল প্রকারের কণ্ঠরোধ সত্ত্বেও তারা
নিজেদের মতো করে লড়াইয়ের পথ খুঁজে চলেছে। লিখছেন
আশিস পাঠক |
খেল এখনও খতম হয়নি। অন্তত ফ্যাতাড়ুদের নবতম কৌশলটি সেটাই জানান দিচ্ছে। কাঁচিবাবু এবং নগরপালেরা চেয়েছিলেন বোমাগুলিতে জল ঢেলে দিয়ে ‘কাঙাল মালসাট’ নামক ডুবোজাহাজটিকে একেবারে ডুবিয়ে দিতে। কিন্তু এই একুশ শতকে কেবল সেন্সরের কাঁচিতে কি আর কুলোয়? তাই ফ্যাতাড়ুরা অন্য মাটি ফুঁড়ে বেরোতে চেয়েছে। সিনেমাটির শুভমুক্তির দিন, অর্থাৎ ২ অগস্ট প্রেক্ষাগৃহেই বিক্রি হবে অভিনব এক মালসাট-প্যাকেজ। খবরে প্রকাশ, সেই প্যাকেজে থাকবে একটি বই ও একটি অডিয়ো অ্যালবাম। বইয়ে থাকবে ‘কাঙাল মালসাট’ উপন্যাস ও চলচ্চিত্র অবলম্বনে নির্মিত একটি গ্রাফিক নভেল। অ্যালবামে সেন্সরের কাঁচিতে বাদ পড়া সংলাপগুলি।
যেন একটি কামান, দুটি কামানের গোলা! বই আর অডিয়ো সিডি দুটোই প্রকাশের আগে আইনত কোনও ছাড়পত্র লাগে না। সেন্সর তথা সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশনের বিরুদ্ধে বিস্তর মিটিংমিছিল জাতীয় প্রতিবাদ না করে ফ্যাতাড়ুরা যে রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াইয়ের এই মোক্ষম কৌশলটি বেছে নিয়েছে তাতেই স্পষ্ট যে, এই বাঙালি ফ্যাতাড়ুরা ‘খচ্চর’ হতে পারে, ‘অসহায়’ নয়। নিশ্চয় সে কারণেই নিজেদের কথাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার এই সুসিদ্ধ অভিসন্ধি। |
ছবি: কবীর সুমন, ‘কাঙাল মালসাট’-এ দণ্ডবায়সের ভূমিকায় |
অনেকে হয়তো একে বিপণনের কৌশল বলবেন। তা হতেও পারে। কিন্তু এ কৌশলে যদি আরও বেশি মানুষ ‘কাঙাল মালসাট’ দেখতে হলে ভিড় করেন, তা হলে ফ্যাতাড়ুদেরই তো কেল্লা ফতে! যে কথাগুলো বলতে গিয়ে সেন্সরের ‘হুলো’ খেতে হয়েছিল সেগুলো আর এক রকম ভাবে আইনত মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া গেল।
এ ভাবে না করেই বা উপায় কী? রাষ্ট্র ফ্যাতাড়ুদের গলা টিপে ধরতে চায়। পরিবর্তিত কিংবা অপরিবর্তিত, সব রাষ্ট্রই চেয়েছে, চিরকাল। গলা টিপে ধরাটাই যেখানে উদ্দেশ্য সেখানে বাক্স্বাধীনতার জন্য গলা ফাটিয়ে যে কোনও কাজ হয় না সেটা আমরা বুঝি না, ফ্যাতাড়ুরা বোঝে। তাই কৌশলে তারা লড়াই চালিয়ে যায়, সহজে ক্ষুদিরাম হয় না। সেই কৌশলী লড়াইটার গল্পই তো নবারুণ ভট্টাচার্যের ‘কাঙাল মালসাট’। দীর্ঘ দশ বছর তার সমস্ত ‘অশ্লীল’ দুঅক্ষর-চারঅক্ষর নিয়ে বইটি পড়েছিল দোকানে দোকানে। টনক নড়েনি কারও। কিন্তু যেই তাকে নিয়ে সিনেমা তৈরি করলেন সুমন মুখোপাধ্যায় অমনি এই দৃশ্য, ওই সংলাপের দিকে কাঁচি ধেয়ে গেল। কাঁচির অবশ্য দোষ নেই। এ দেশে শুধু সিনেমা নিয়েই এখনও সেন্সরের প্রবল উদ্যোগ। অথচ স্বাধীনতার প্রায় সাত দশক পরে আত্মপ্রকাশের বহু নতুন মাধ্যম ইতিমধ্যে সচল, সেন্সর যাদের টিকিও ধরতে পারে না।
কিন্তু ফ্যাতাড়ুরা, সিবিএফসি-কর্তৃক নিষিদ্ধ সংলাপ-সহ দৃশ্যগুলি ইউটিউব বা সমগোত্রীয় পথে আপলোডের মতো বেআইনি কাজ করেনি। কেবল কাটা অংশগুলিকেও আইনি মাধ্যমে সেন্সর্ড সিনেমার সঙ্গে প্রকাশ করে দিতে চেয়েছে একটা প্যাকেজে। রাষ্ট্রের আইন মেনেও যে রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই করা যায় সেটা এ ভাবেই দেখিয়ে দিল ফ্যাতাড়ুরা।
কবি পুরন্দর ভাট অবজ্ঞার গ্লানি সহ্য করতে না পেরে সুইসাইড করেছিলেন। তাঁর ইহজীবনের শেষ কবিতাটি আমাদের প্রথাগত আইন অমান্যের একটি সকরুণ দিক তুলে ধরেছিল। কবি পুরন্দর লিখেছিলেন,
‘আমার জীবনে নাই কেন কোনো ড্রামা
তাই দিব আমি কার্পাস ক্ষেতে হামা
...আমার মরণে হয় না তো হেডলাইন
প্রাসাদ গাত্রে মুতিয়া ভাঙিব আইন...’
বৃদ্ধ দণ্ডবায়স উড়ে গিয়েছেন অনেক দিন। মার্শাল ভদি কবেই সাদ্দাম হুসেন হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু ফ্যাতাড়ুদের মরণ নেই। রাষ্ট্রের সকল প্রকারের কণ্ঠরোধ সত্ত্বেও তারা নিজেদের মতো করে লড়াইয়ের পথ খুঁজে চলেছে। মহাচমকপ্রদ ঘটনা এটি, ঠিক তাদের আবির্ভাবের মতোই। |