‘লুটেরা’র ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো দেখার পর একটা কথাই বারবার শোনা যাচ্ছিল। বিক্রমাদিত্য মোতওয়ানের ছবিতে পুরুলিয়া আর বর্ধমানকে অপরূপ সুন্দর দেখতে লেগেছে। সেই পুরনো মন্দির, সেই খন্ন্যানের রাজবাড়ি অনেক দর্শকেরই মনে হয়েছে এ যেন চিত্রগ্রাহক মহেন্দ্র জে শেট্টির হাত ধরে নতুন করে বাংলাকে চেনা। সোনাক্ষী বা রণবীর সিংহ যে নজর কাড়বেন, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু নতুন চোখ দিয়ে দেখা সেই চেনা পরিচিত বাংলার পটভূমি হয়ে উঠেছে ছবির এক অন্যতম চরিত্র। এটা কি শুধুমাত্র চিত্রপরিচালকের ক্যামেরার জাদু? বলিউড যা পারছে, টলিউড সেটা করে দেখাচ্ছে না কেন? বাজেটের ঘাটতির জন্যই কি পিছিয়ে পড়ছে বাংলা সিনেমা?
অনেকেই মনে করছেন, ‘লুটেরা’ জাতীয় দর্শকের নজরটা আবার বাংলার দিকে ঘুরিয়ে দিচ্ছে। অনুরাগ বসু ঠিক যা করেছিলেন ‘বরফি’ ছবিতে। দার্জিলিংকে এমন ভাবে তিনি সিনেমার পর্দায় নিয়ে এসেছিলেন যে, পাহাড়ের সেই চেনা পরিচিত বাঁকগুলোই নতুন ভাবে নজরে এসেছিল। একই জিনিস সুজয় ঘোষ করেছিলেন ‘কহানি’ ছবিতে। সেই ছবির মধ্যে দিয়ে কলকাতাকে নতুন করে চিনছে জাতীয় দর্শক। গলি থেকে ট্রাম-গুমটি, সত্যজিৎ পাণ্ডের লেন্সে একদম অন্য রকম লেগেছে দেখতে। |
টলিউডের বহু ছবি হয়তো সেই এক লোকেশনেই শ্যুটিং হয়েছে। কিন্তু সেই ছবিগুলোর দৃশ্যায়নের সঙ্গে বলিউডের বাংলাকে দেখানোর প্রচেষ্টার যথেষ্ট ফারাক। শিরিন গুহ ‘লুটেরা’-তে সোনাক্ষীর বন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন। বলছেন, “এই ছবির জন্য আমি খন্ন্যানের রাজবাড়িতে শ্যুটিং করেছি। অবাক হয়েছি দেখে, কী ভাবে ওঁরা কলকাতার আশেপাশে এমন সুন্দর জায়গা খুঁজে বার করেছেন। ঋতুপর্ণ ঘোষ ছাড়া এখনকার ক’জন বাঙালি পরিচালক পিরিয়ড ছবি বানিয়ে গোটা দেশের নজর কেড়েছে? বিক্রমাদিত্যের মতো এই রকম ডিটেলে কাজ কেন হয় না বাংলাতে?” এমন নয় যে, বাংলা ছবিতে নিসর্গ দৃশ্য বেশি ব্যবহার করা হয়নি। কিন্তু হালফিলের অনেক বাংলা ছবিই সম্পর্কভিত্তিক। চার দেওয়ালের মধ্যেই গল্প বলা শেষ।
সেখানে নিসর্গ দৃশ্য নিয়ে কাজ করার সুযোগটাও বেশি নেই। তবু ‘দুই পৃথিবী’র শ্যুটিং হয়েছিল পুরুলিয়ায় আর দুর্গাপুর এক্সপ্রেস হাইওয়েতে। ‘বোঝে না সে বোঝে না’-তে দেখা গিয়েছে গৌড়, মালদহ। ‘কানামাছি’র জন্য রাজ চক্রবর্তী ছুটেছিলেন বোলপুরে। সামনে মুক্তি পাচ্ছে রাজের ‘প্রলয়’। পরিচালক বলেন, “হিন্দি ছবি নিয়ে মাতামাতিটা বেশি। চ্যালেঞ্জ করছি, যে ভাবে ‘প্রলয়’-এ বাংলার ল্যান্ডস্কেপ দেখিয়েছি, ‘লুটেরা’ তার ধারেকাছে আসতে পারবে না। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের ছবিগুলোতে পুরুলিয়াকে কী অসাধারণ ভাবে দেখানো হয়েছে। খন্ন্যান রাজবাড়িতেই বহু বছর আগে রবি ওঝা শ্যুট করেছিলেন ‘আবার আসব ফিরে’। তার পরে হয়েছে ‘তবে তাই হোক’।” তার মানে কি গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না? “একদমই তাই। আমরা যাই করি, সেটা অতটা প্রশংসিত হয় না। বাজেটই এক মাত্র সমস্যা নয়। গ্রামে গিয়ে কোনও ছবির শ্যুটিং করার জন্য ছবির বিষয়টাও সেই অনুযায়ী হওয়া দরকার,” রাজ বলছেন।
তাঁর মতে, টলিউডের আর একটা বিশাল সমস্যা হল ভিড় সামাল দেওয়ার ব্যর্থতা। বললেন, “দেব আর জিৎকে নিয়ে বাংলার গ্রামে শ্যুটিং করাটা খুবই অসুবিধের। ভিড় সামলানো যায় না। বলিউড তারকাদের ক্ষেত্রে ওই একই সমস্যা হলে পুরো সেট তৈরি করে ওরা মুম্বইতে শ্যুটিং করে। প্রযুক্তির সাহায্যে তার পর সিনগুলো মিলিয়ে দেওয়া হয়। রণবীর কপূরকে নিয়ে দার্জিলিঙে ‘বরফি’-র শ্যুটিংয়ের সময় অসুবিধে হয়েছিল। তখন এ ভাবেই প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে কাজ শেষ করা হয়েছিল।” |
বাংলা ছবিতে এ রকম ভাবে কাজ করা যায় না? রাজের মতে, “এ রকম করার মতো বাজেট আমাদের থাকে না। ঝামেলা হলেও আবার সেই গ্রামেই তারকাদের নিয়ে ফেরত যেতে হয়। বাজেটে কুলিয়ে গেলে কেউ কেউ
হাল ছেড়ে দিয়ে বিদেশে শ্যুটিং করতে চলে যান।”
‘লুটেরা’-তে সোনাক্ষীর বাবার চরিত্রে অভিনয় করেছেন বরুণ চন্দ। খন্ন্যান রাজবাড়িতে বাংলা টেলিফিল্মের জন্য শ্যুটিং করেছেন এর আগে। তিনি কী বলছেন? “বিক্রমাদিত্যের চোখটাই অন্য রকম। বহিরাগতের দৃষ্টি যাকে বলে।” বরুণবাবুর মত, গ্রামবাংলাকে সিরিয়াল বা বড় পর্দায় দেখাতে গেলে সাধারণত একটা ফর্মুলা ব্যবহার করা হয় টলিউডে। “ওই একটু গ্রামের পটভূমি, একটা কলাগাছ, একটা পুকুর, জমিদারবাড়ি আর তার পর সংলাপ শুরু। তাড়াতাড়ি গল্পে চলে যাওয়ার একটা প্রবণতা আছে। কিন্তু ‘লুটেরা’র দৃষ্টিভঙ্গিটাই আলাদা। আল দিয়ে হেঁটে যাওয়া, দূরে হলুদ সর্ষেখেত, ধূসর রাস্তা দিয়ে ছুটে চলেছে ভিন্টেজ গাড়ি দেখে মনে হয় যেন বিদেশি ছবি,” বলছেন বরুণ। এ সব শুনে বিক্রমাদিত্য উৎফুল্ল। বলছেন, “আমি মনে করি এটা অনেকটাই অনুরাগ কাশ্যপের ‘ব্ল্যাক ফ্রাইডে’র শ্যুটিংয়ের মতো। অনেকে বলেন মুম্বইকে কেউ এ ভাবে দেখাতে পারেনি। হয়তো তার একটা কারণ, অনুরাগ মুম্বইয়ে মানুষ হয়নি। ড্যানি বয়েলও ‘স্লামডগ মিলিয়নেয়ার’-এ মুম্বই দেখিয়েছিলেন। সে যেন এক অন্য শহর।” নিজের ছবি প্রসঙ্গে বিক্রমাদিত্য শুধু বলছেন, “আমার চিত্রগ্রাহক মহেন্দ্র এক জাদুকর!”
একই কথা বলছেন অনিরুদ্ধ রায় চৌধুরী। সব কিছুর মূলেই হল টালিগঞ্জে ‘বহিরাগতের দৃষ্টির’ অভাব। “নিজের স্ত্রীকে রোজ দেখছেন। তাঁকে আবার অন্য পুরুষ অন্য চোখে দেখলে নতুন ভাবে আবিষ্কার করবেন। ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ হিসেবে নেবেন না,” বলছেন অনিরুদ্ধ।
তবে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র শিক্ষা বিভাগের প্রধান মৈনাক বিশ্বাস মনে করছেন, পার্থক্যের কারণটা অনেকটাই অর্থনৈতিক। “স্থানীয় পরিচালক নিজের শহরকে যে ভাবে দেখবেন, তার থেকে বাইরের একজনের দেখা অন্য রকম হওয়াটাই স্বাভাবিক। তবে ছবির লুকটা অনেক ক্ষেত্রেই পালটে যায় ছবির বাজেটের কারণে। দামি সেট, পোশাক, আলো, ইমেজের ডিজিটাল ম্যানিপুলেশন এ সব বাজেট নির্ভর। বেশি বাজেট থাকলে ভাল ভাল টেকনিশিয়ানও পাওয়া যায়।”
চিত্রগ্রাহক সৌমিক হালদারও বাজেটের কথাটাই তুলে আনছেন। বলছেন, “একটা হিন্দি ছবিতে অনেক দিন ধরে অনেকে মিলে কাজ করার সুযোগ পায়। কিন্তু বলিউডের ম্যানপাওয়ার আর সময় বেশি থাকার দরুন অনেক কিছু অন্য ভাবে করা সম্ভব। আমি ‘মেঘে ঢাকা তারা’র পুরো শ্যুটিং শেষ করেছি বত্রিশ দিনে। কিন্তু একটা হিন্দি ছবি কম করে আশি দিন ধরে শ্যুট করে। আমরা যেখানে একদিন শ্যুট করতে পারি, সেখানে বলিউড হয়তো পাঁচ দিন করবে। আমরা একটা ক্যামেরাতে শ্যুট করলে ওরা তিনটেতে শ্যুট করে। তাই ওদের ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল বেশি। আমাদের ছবির বাজেট বলিউডের মতো হয় না। রাস্তা বন্ধ করে শ্যুটিং করতে যা টাকা লাগে তা-ও আমাদের থাকে না। আমাদের টেকনিশিয়ানরা খুবই পারদর্শী। কিন্তু বলিউডের পরিকাঠামো আমরা পাই না।”
বড় বাজেটের আনুকুল্যই হোক বা দৃষ্টিভঙ্গির আলসেমি থেকে বেরোনোর চেষ্টা, জাতীয় পর্দায় বাংলার প্রত্যাবর্তনে লাভ এ রাজ্যেরই। |