মিশরের প্রথম অবাধ নির্বাচনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত অসামরিক প্রেসিডেন্ট মহম্মদ মুর্সি গদিচ্যুত এবং গৃহবন্দি হইলেন। সেনাবাহিনী তাঁহাকে ক্ষমতাচ্যুত করিয়া সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি আদলি মনসুরকে অস্থায়ী ও অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করিয়াছে। ইহা দীর্ঘ কাল ধরিয়া ফৌজি স্বৈরাচারে অভ্যস্ত এবং অধুনা গণতন্ত্রে রূপান্তরিত মিশরের নবীন গণতন্ত্রের পক্ষে এক বিরাট ধাক্কা। কারণ ‘আরব বসন্ত’-এর সময় যখন একের পর এক মুসলিম রাষ্ট্রে স্বৈরাচারী জমানা ফেলিয়া দিয়া বিদ্রোহী জনগণ প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনপ্রণালী আবাহন করিতেছিলেন, মিশর সেই ধারা ও প্রক্রিয়াতেই হোসনি মুবারকের একনায়কত্ব ছুড়িয়া ফেলে। অতঃপর মিশরের পার্লামেন্টে যে-নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, তাহাতে মুসলিম ব্রাদারহুড নিয়ন্ত্রিত ফ্রিডম অ্যান্ড জাস্টিস পার্টিই অধিকাংশ আসনে জয়ী হয়। ব্রাদারহুডের প্রার্থী হিসাবেই মহম্মদ মুর্সি প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জয়ীও হন। বছর ঘুরিতে-না-ঘুরিতেই তাঁহার বিদায়ঘণ্টা বাজিয়া গেল।
এই অনভিপ্রেত পরিণামের জন্য অন্তত অংশত মুর্সি নিজেই দায়ী। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পরেই তাঁহার সহিত এক দিকে ফৌজি জেনারেল, অন্য দিকে বিচারব্যবস্থার সহিত তাঁহার সংঘাত বাধে। সত্য, এই দুই প্রতিষ্ঠানই মুবারক জমানার অবশেষ বহন করিতেছে। অধিকাংশ বিচারপতি এবং সেনা-জেনারেলই মুবারকের আমলেই নিযুক্ত। ফলত তাঁহাদের সহিত ব্রাদারহুডের প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর সংঘাত একপ্রকার অনিবার্যই ছিল। কিন্তু মুর্সি এই দ্বন্দ্বে মিশরের গণতন্ত্রকামী জনসাধারণের উপর ভরসা করেন নাই। পরিবর্তে ব্রাদারহুডের নেতাদের পরামর্শে ক্রমশ নিজের হাতে প্রশাসনিক, বিচারবিভাগীয়, এমনকী সাংবিধানিক ক্ষমতাও কুক্ষিগত করিয়া চলেন। একের-পর-এক ডিক্রি জারি করিয়া তিনি নিজের সিদ্ধান্তকে সাংবিধানিক ও বিচারবিভাগীয় পর্যালোচনার ঊর্ধ্বে লইয়া যান এবং তাঁহার মধ্যে স্বৈরাচারী শাসকের লক্ষণগুলি একে-একে পরিস্ফুট হইতে থাকে। এই অবস্থায় মিশরীয় জনগণের সামনে উপায় কী ছিল? নীরবে একজন স্বৈরাচারীর বিদায়ের সুযোগে আর একজন রাজনীতিককে স্বৈরাচারী হইয়া উঠিতে দেওয়া? তাহরির স্কোয়ারে সমবেত জনগণ মুর্সির আচরণ, কথাবার্তা, ভাবে-ভঙ্গিতে স্পষ্টতই স্বৈরাচারীর অভ্যুদয়ের সিঁদুরে মেঘ প্রত্যক্ষ করিতেছিলেন। তাঁহাদের পক্ষে অঙ্কুরেই সেই সম্ভাবনা বিনাশের চেষ্টা করা বোধহয় অসঙ্গত নয়।
কেবল কায়রোর তাহরির স্কোয়ারই নয়, আলেকজান্দ্রিয়া, পোর্ট সইদ সহ মিশরের বিভিন্ন শহর ও জনপদেই বিক্ষোভ আছড়াইয়া পড়ে। দেশের আর্থিক দুরবস্থা, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের অনটন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে পথে-নামা জনসাধারণের উপর পুলিশি দমননীতি ও তাহাতে নিরস্ত্র প্রতিবাদীদের মৃত্যু বিক্ষোভের মাত্রা বাড়াইয়া দেয়। জনসাধারণ প্রেসিডেন্ট মুর্সির পদত্যাগ এবং নূতন করিয়া প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দাবিতে তীব্রতর আন্দোলনে অবতীর্ণ হন। সেনাবাহিনী এই অবস্থায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা লইয়া উভয় পক্ষকেই আপসে দ্বন্দ্ব মিটাইয়া ফেলার আবেদন জানায়, অন্যথায় স্থিতি ও শৃঙ্খলা আনিতে হস্তক্ষেপ করার হুঁশিয়ারি দেয়। শেষাবধি সেই হুঁশিয়ারিই কার্যকর হইয়াছে। সেনা-জেনারেলরা যদি পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের তত্ত্বাবধান করা অবধি তদারকের ভূমিকা পালন করিয়া আবার ছাউনিতে ফিরিয়া যান, তবে এই হস্তক্ষেপ মিশরের গণতন্ত্রের পক্ষে উপকারীই সাব্যস্ত হইতে পারে। কিন্তু জেনারেলরা যদি রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করেন, (যাহার ইতিহাস মিশর-সহ সমগ্র আরব-এশীয় ভূখণ্ডেই ধারাবাহিক) তবে বিপর্যয়ই ভবিতব্য। নূতন নির্বাচন হইলে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট গণতন্ত্রীদের পছন্দের রাজনীতিক হইবেন, নাকি অপছন্দের, মুসলিম ব্রাদারহুডই বা তাঁহাকে পছন্দ করিবে কি না, অপছন্দ হইলে আবার প্রতিবাদের প্লাবন নূতন প্রেসিডেন্টকে গদি ছাড়িতে বাধ্য করিবে কি না, সেই আন্দোলন জেনারেলরা সমর্থন করিবেন, নাকি বিরোধিতাইত্যাকার বিভিন্ন রকম অস্বস্তিকর প্রশ্ন লইয়াই মিশরকে এখন সম্মুখে তাকাইতে হইবে। |