|
|
|
|
|
|
|
আজ সাক্ষাৎকার দিলেন: উত্তমকুমার
|
শান্তনু চক্রবর্তী |
মূর্তির সামনে থেকে ‘ইউ’ টার্ন করে মেট্রো স্টেশনের কাছাকাছি আসতেই অন্ধকার ফুঁড়ে তিনি এগিয়ে এলেন! তার পর মাঝরাত্তিরে গাড়ি করে টালিগঞ্জের স্টুডিয়োপাড়ায় ঘণ্টাখানেক চক্কর দিতে দিতেই ইন্টারভিউ! পয়লা প্রশ্ন তিনিই ছুড়লেন।
উত্তমকুমার: আচ্ছা, একটা কথা বল তো, কোন শালা টালিগঞ্জের মোড়ে আমার স্ট্যাচুটা বসিয়েছে?
প্রতিবেদক: না, মানে, ও ভাবে এক জন কেউ তো বসায়নি। ধরে নিন না কলকাতার নাগরিক সমাজ, আসমুদ্রহিমাচল আপনার ফ্যানকুল, তাঁরাই খরচাপাতি করে নামী শিল্পীকে দিয়ে বানিয়েছেন!
উত্তম: আমার চোদ্দো পুরুষ উদ্ধার করেছেন! বসানোর আগে এক বার দেখে নেবে না, মালটা উত্তমকুমার হয়েছে না হরেকেষ্ট খাঁড়া?
প্রতি: না মানে আপনাকে কেমন দেখাচ্ছে, সেটাই তো বড় কথা নয়— আপনাকে নিয়ে জনতার ভালবাসা, আবেগ...
উত্তম: ও সব পুড়কি খাইয়ে অনেক ভুলভাল লোক আমাকে দিয়ে অনেক ভুলভাল ছবি করিয়ে নিয়েছে! তার পর যখন বক্স অফিসে হড়কেছে, তখন আড়ালে আমায় খিস্তি করেছে! আমি যেন গোটা টালিগঞ্জের ঠেকা নিয়ে বসেছিলাম! যত গবা ডিরেক্টর, যত আনতাবড়ি কাজ, সব আমায় উতরে দিতে হবে! কেন রে শালা, তোদের সব গু আমাকে সাফ করতে হবে কেন?
প্রতি: আপনার পুরনো ইন্টারভিউ পড়েছি, পুরনো লোকজনের সঙ্গে কথাও বলেছি। এত মুখ খারাপ করতেন বলে তো শুনিনি!
উত্তম: তখন করতাম না। এখন ঝেড়ে খিস্তি করে নিলে দেখেছি, ভেতরটা হালকা লাগে!
প্রতি: আপনি বলছেন, বাজে ডিরেক্টরের আনাড়ি ছবি ঘাড়ে কাঁধে বইতে বইতে মেজাজ তিতকুটে হয়ে গেছে— কিন্তু ওটা তো আপনার নিজের চয়েস! আপনাকেই বা কে মাথার দিব্যি দিয়েছিল অ্যাটলাসের মতো টালিগঞ্জকে বইতে হবে? তখন ছবি সই করার আগে স্ক্রিপ্ট-টিপ্ট পড়ার কোনও বালাই ছিল না, না?
উত্তম: শোন বাচ্চু, আমার যে এত সম্মান, চাদ্দিক থেকে আমি যে এতটা পুজো পাই, তার একটা বড় কারণ অ্যাক্টিং নয়, এই স্যাক্রিফাইস। শুধু নিজের কেরিয়ার-উন্নতির কথা না ভেবে গোটা টালিগঞ্জের কেরিয়ারের কথা ভাবা। অ্যাটলাসের মতো দায়িত্ব নিতে হবে কেউ বলেনি, আর সেই জন্যেই যেচে দায়িত্বটা নেওয়ার এতখানি গ্লোরি।
|
|
উত্তমকুমার, এখন যেমন। ফোটোগ্রাফারের হাত ভয়ে, শ্রদ্ধায় ও রোমাঞ্চে কেঁপে যাওয়ায়, ছবিটা নড়ে গেছে। |
প্রতি: তা হলে আবার মেজাজ খারাপ কেন? উত্তম: কারণ মহত্ত্বেরও একটা হ্যাংওভার থাকে। শেষ অবধি তো লোকে কাজ দিয়েই বিচার করে। সেখানে বড্ড বেনো জল রয়ে গেল। আর একটা সত্যি বলি। পুরোটা পরোপকারের ট্রিপ নয়। শেষ দিকটা আমার চয়েস ছিল না! বয়স হয়ে যাচ্ছিল! চুল পাতলা, গাল ভারী, চোখের নীচে দু-তিনটে ভাঁজ, থুতনির নীচে দু-তিন থাক চর্বি! কী করতাম? কলেজের ছাত্তর সেজে প্রেম করতে তো পারতাম না। তাই যখন যেমন অফার এসেছে নিয়ে নিয়েছি। অত বাছাবাছি করতে পারিনি। আমাদের বিশুর ব্যাটা প্রসেনজিৎ যে ভাবে ঋতুপর্ণকে পেয়েছিল, আমার তো তেমন কেউ ছিল না!
প্রতি: প্রসেনজিৎ যখন ঋতুপর্ণর ছবি করতে আসছেন, তখন কিন্তু তিনি টালিগঞ্জের এক নম্বর হিরো, ধারেকাছে কেউ নেই। আপনি যখন ভুরু এঁকে, গালে রুজ, ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে সুচিত্রা সেনের সঙ্গে একটার পর একটা বক্স অফিস হিট দিচ্ছেন, তখন কি অন্য রকম সিনেমাওয়ালাদের ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতেন?
উত্তম: হ্যাঁ, কেন নয়? ঋত্বিকবাবু, তপন সিংহদের সঙ্গে কথাবার্তাও এগিয়েছিল তো। কখনও বাজেট, কখনও ডেট-এর সমস্যা, এ সবের জন্যই আটকে গেছে!
প্রতি: ওগুলো অজুহাত। আসল কথা বলুন। চ্যালেঞ্জটা আপনি নিতেন না। ভয় পেতেন।
উত্তম: ভয়? কাকে ভয়? কীসের ভয়?
প্রতি: নিজেকে ভয়, অভিনেতা হিসেবে আপনার খামতিগুলো ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়! আপনি মেথড অ্যাক্টিং জানতেন না, পড়াশোনা কম— এই সে দিনও মৃণাল সেন বলেছেন।
উত্তম: তার পরেও সত্যজিৎ রায় ‘নায়ক’-এর জন্য আমাকেই ডেকেছিলেন!
প্রতি: কিন্তু সত্যজিৎও কক্ষনও আপনাকে চরিত্রটার ল্যাজামুড়ো বোঝাতে যাননি। কারণ বোঝালেও আপনার মগজে ঢুকবে কি না সেটা নিয়ে তাঁর ঘোর সন্দেহ ছিল!
উত্তম: আর তোমার ওই মগজওয়ালা ‘সেরিব্রাল’ হিরোদের অ্যাপিল যে প্রেসিডেন্সি কলেজের গেট টপকে কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাত অবধি পৌঁছয় না, সেটাও তো সত্যজিৎ রায়ই বলে গেছেন, তাই না? ১৯৮০-র জুলাইয়ের দু-তিন বছর পর জন্মেছে, সেই সব বাচ্চা-বাচ্চা ছেলেমেয়েরাও আজ আমার সিনেমা বলতে অজ্ঞান! তুমি খোঁজ নিয়ে দ্যাখো!
প্রতি: খোঁজ নেওয়ার কী আছে? এই তো জুলাই মাস পড়বে আর আর চ্যানেলে চ্যানেলে উত্তম-তর্পণ শুরু হয়ে যাবে। আপনার রেট্রো। টিআরপি না থাকলে কি আর দেখাত?
উত্তম: তব্বে! আর ক’টা বছর বাঁচতে পারলে, ও সব ঢপের মেথড অ্যাক্টিং কাকে বলে দেখিয়ে দিতাম তোমাদের মৃণাল সেন-কে। সঙ্গে সঙ্গে আবার এটাও মনে হয়, বুঝলে, বেশি দিন বাঁচলে কি আর টিআরপি এই জায়গায় থাকত? আমাদের সময়ের ডাকসাইটে নায়িকাদের হাল তো দেখছি। যে অভিনয় করতে চায় না, তাকে গ্ল্যামার রাখতে মুখ ঢেকে হাসপাতালে যেতে হয়। আর যে অভিনয় করতে চায়, তাকে দিয়ে তো এই জমানা তুড়ুক নাচন নাচিয়ে নিচ্ছে। আমায় কী করতে হত কে জানে। ভিলেনের দাদু হিসেবে ভুঁড়ি আর ভাঁড়ামো পাঞ্চ করে খোকা চারশো বিশ-কে কড়কাতে হত মনে হয়।
প্রতি: অনেক মেগাসিরিয়াল থেকেও ডাক আসতে পারত।
উত্তম: আসতই! তার পর রান্নার রিয়েলিটি শো-তেও যেতে হত, কিংবা গুঁড়ো মশলার বিজ্ঞাপনে। সেখানে আমি বাঁধানো দাঁতে মুরগি চিবোতাম আর তোমরা দাঁত বার করে হাসতে! বাপ, কী বাঁচা যে বেঁচে গেছি!
প্রতি: আপনার নামে যে একটা আস্ত মেট্রো স্টেশন, গর্ব হয় না?
উত্তম: নিজেকে স্যান্ডউইচের পুরের মতো মনে হয়। আগে-পিছে মাস্টারদা সূর্য সেন, শহিদ ক্ষুদিরাম, নেতাজি, রবীন্দ্রনাথ, মাঝখানে আমি মহানায়ক উত্তমকুমার, আবার অ্যানাউন্সমেন্টের সময় ‘ইতি গজ’-র মতো করে বলে: টালিগঞ্জ এলাকার জন্য!
প্রতি: এটা তো মানবেন, বামফ্রন্ট আমলে মারা গিয়েছিলেন বলেই আপনাকে যথেষ্ট সম্মান দেখানো হয়নি। এই সরকারের আমলে মারা গেলে ‘গান স্যালুট’ বাঁধা ছিল। আপশোস হয়?
উত্তম: হয়। ফিল্মের লোক গান স্যালুট পাচ্ছে এমনটা মার্লন ব্র্যান্ডোর বেলাতেও হয়েছে বলে শুনিনি। ওটা পেলে মন্দ হত না। কিন্তু তার জন্য আমাকে যদি গোটা পাঁচেক শহিদ দিবস আর বিজয় উৎসবের মঞ্চে উঠে হাত-পা নেড়ে ‘বিপিনবাবুর কারণসুধা’ বা ‘লোলালুলুু’ গাইতে হত, পেরে উঠতাম না। মাথায় পাগড়ি পরে বা গালে দাড়ি লাগিয়ে রামমোহন বা রবীন্দ্রনাথ সেজে স্টেডিয়ামে হাঁটতেও বোধ হয় বাধত। গোটা কয়েক বঙ্গভূষণ, বঙ্গবিভূষণ দিলেও তোদের মহানায়ক ওইখানটায় ফেল মেরে যেত! |
|
|
|
|
|