|
|
|
|
|
|
 |
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
হারিয়ে যাওয়ার মধ্যেও ফুটে ওঠে আত্মবিচ্ছিন্নতা |
এক্সপেরিমেন্টার-এ অনুষ্ঠিত হল হাজরা ওয়াহিদের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ |
প্রাচীন কাল থেকে আধুনিকতার যুগ পর্যন্ত মানুষের শিল্পকলার ভিতর সব সময়ই এক ধরনের ‘মহনীয়তা’ কাজ করেছে। মানুষকে তা বিস্মিত ও আবেগ-আপ্লুত করেছে। গুপ্ত বুদ্ধ থেকে কিষণগড়ের রাধা, মাইকেল এঞ্জেলোর ‘পিয়েতা’ থেকে পিকাসোর ‘গের্নিকা’, অবনীন্দ্রনাথের ‘আরব্য-রজনী’ চিত্রমালা থেকে রামকিঙ্করের সাঁওতাল পরিবার বা ‘কলের বাঁশি’ সব ক্ষেত্রেই এই ‘মহনীয়তা’র নজির রয়েছে। ওয়াল্টার বেঞ্জামিন ১৯৩৬-এ লেখা ‘দ্য ওয়র্ক অব আর্ট ইন দ্য এজ অব মেকামিকাল রিপ্রোডাকশন’ নামে তাঁর বিখ্যাত প্রবন্ধে একে বলেছিলেন ‘অরা’। মুদ্রণ-ব্যবস্থা আসার পর সেই ‘অরা’ বা ‘মহনীয়তা’ যে একেবারে কেটে গিয়েছিল, তা নয়। তবে তার চরিত্র বিবর্তিত হয়েছিল। উত্তর-আধুনিকতার প্রকল্পের একটা ‘অ্যাজেন্ডা’ ছিল দৃশ্যকলাকে এই ‘অরা’ থেকে বের করে আনা। এর একটি দৃষ্টান্তের উল্লেখ করা যায়। আমেরিকান শিল্পী জন বালডেসারির ১৯৬৮-র একটি চিত্রধর্মী রচনার শিরোনাম ‘হোয়াট ইজ পেইন্টিং’। এতে তিনি কোনও ছবি আঁকেননি। শুধু পেন্টিং-এর সংজ্ঞা লিখে দিয়েছিলেন ক্যানভাসের উপর। প্রতিমাকল্পের কোনও মায়া রচনা করেননি তিনি। তিনি জাগাতে চেয়েছেন দর্শকের বৌদ্ধিক চেতনা। উত্তর-আধুনিক ‘কনসেপচুয়াল আর্ট’-এর এটাই একটা ধরন। এখন বিশ্ব জুড়ে এরকম আবেগবর্জিত চর্চা নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হচ্ছে। একে দৃশ্য-কলা বলে গ্রহণ করবেন কি করবেন না, দর্শকের ব্যাপার।
এরই একটি দৃষ্টান্ত আমরা সম্প্রতি দেখলাম এক্সপেরিমেন্টার-এ অনুষ্ঠিত কানাডার শিল্পী হাজরা ওয়াহিদ-এর একটি প্রদর্শনীতে। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘সি চেঞ্জ’। তাঁর অধিকাংশ রচনাই পুরোনো আলোকচিত্র ভিত্তিক। অবয়বী ও নিসর্গমূলক প্রতিমাকল্পের ব্যবহারও তাতে আছে। কিন্তু দৃশ্যতার ভিতর কোনও আবেগদীপ্ত বহনীয়তা বা ‘অরা’ প্রশ্রয় পায়নি। উন্নয়নের অছিলায় অনেক মানুষ তাঁদের স্বভূমি থেকে উৎখাত হয়, স্থানান্তরিত বা অভিবাসিত হয়। কালক্রমে তারা হারিয়ে যায়। অস্তিত্ব থেকে অনস্তিত্বে যাওয়ার এই সমস্যাই শিল্পীকে ভাবিয়েছে। এরই বিরুদ্ধে তিনি করুণাদীর্ণ প্রতিবাদী আবহ তৈরি করতে চেয়েছেন। |
 |
শিল্পী: হাজরা ওয়াহিদ |
সেটা তিনি যেভাবে করেছেন, তা প্রথাগত চিত্ররীতি থেকে আলাদা। আমরা তাঁর কয়েকটি কাজ অনুধাবনের চেষ্টা করতে পারি। ন’টি ছবির একটি মালাচিত্র আছে। শিরোনাম ‘দ্য মিসড’। সাড়ে দশ বাই সাড়ে বারো ইঞ্চি বাদামি কাগজের প্রেক্ষাপটে একটি ছোট কালো আয়তাকার কাগজ সাঁটা আছে। তার উপর আটকানো রয়েছে কোনও যুবকের খুব ছোট আবক্ষ একটি আলোকচিত্র। এ রকম ন’টি ফ্রেম পাশাপাশি সাজানো। প্রত্যেকটিতেই রয়েছে ও রকম ক্ষুদ্রাকার আলোকচিত্র। যাদের ছবি, সেই যুবকেরা সমাজের বিভিন্ন স্তর থেকে এসেছে। পরিব্যাপ্ত প্রত্ন শূন্যতার পরিমণ্ডলে সারবাঁধা ওই ছোট আলোকচিত্রগুলি আপাত ভাবে দর্শকের কাছে কোনও আবেদন রাখে না, যত ক্ষণ না তিনি শিল্পীর ভাবনা সম্পর্কে অবহিত হচ্ছেন। এই লেখার সঙ্গে আমরা যে ছবিটি দেখছি, সেটি ‘দ্য মিসিং’ শিরোনামে ওরকমই ২০টি ছবি সমন্বিত মালাচিত্রের একটি। ওরকমই বাদামি বা ধূসর শূন্যতার প্রেক্ষাপট, মাঝখানে চার জন সুসজ্জিত পুরুষের আলোকচিত্র, যাদের কাঁধ থেকে হাঁটু পর্যন্ত মাত্র দৃশ্যমান। এই যে মানুষগুলো হারিয়ে গেছে, পোশাক বলছে এদের যথেষ্ট সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপত্তি আছে। তা সত্ত্বেও এদের হারিয়ে যাওয়াটা হয়তো আত্মবিচ্ছিন্নতার অন্তর্গত। তাঁদের অস্তিত্বের কোনও দৃঢ় পাদপীঠ নেই। এই বিচ্ছিন্নতা আজকের বিশ্বায়ন অধ্যুষিত সমাজের একটা সমস্যা।
এ ভাবেই শিল্পী তাঁর রচনাগুলিকে সমস্ত রকম মহনীয়তা বা ‘অরা’ থেকে বের করে আনতে চেষ্টা করেছেন। উদ্দেশ্য হয়তো এ রকম যে তা যেন আবেগে কোনও অভিঘাত সৃষ্টি না করে সরাসরি বুদ্ধি বা মস্তিষ্কের কাছে আবেদন রাখে। বুদ্ধি দিয়েই দর্শক যেন এই নামাজিক সংকটকে বিশ্লেষণ করতে পারেন। প্রশ্ন আসে এখানে আবেগ-বর্জিত মস্তিষ্কচর্চা থেকে আমরা কতটা শিল্প তথা জীবনের গভীরে প্রবেশ করতে পারি। শিল্পীর ভাবনা বা ‘কনসেপ্ট’-এর উপরই যদি দর্শকের প্রতিক্রিয়া নির্ভর করে, তাহলে সেই শিল্প কতটা নান্দনিক দায় পালন করতে পারে। কনসেপচুয়াল আর্টের ক্ষেত্রে এই সমস্যাটা অনেক সময়ই বড় করে দেখা দেয়। |
|
|
 |
|
|