বিনোদন নাচ দেখতে সবাই আসে, মরলে
পায়ে দড়ি বেঁধে নিয়ে যায় ডোম
নান্দীকার-এর নতুন নাটক ‘নাচনি’ সম্প্রতি মঞ্চস্থ হয়েছে কলকাতায়। গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক মানুষ আর তাঁদের শিল্পজীবন নিয়ে বড় পরিসরের নাটক এটি। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত মনে করেন, নাচনিদের গল্প বলতে গিয়ে আবার নান্দীকার নতুন করে পা ফেললেন বঙ্গরঙ্গমঞ্চে। ‘‘নাচনিদের নিয়ে কাজ করা যেন সমাজের বিন্যাসটাকেই আবার খতিয়ে দেখা।”
পুরুলিয়ার পাথুরে গ্রামে গ্রামে ঘুরে নাচনিদের নিয়ে উপন্যাস লিখেছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়। বড় দরদ তাঁর সে লেখায়, বলছিলেন তাঁদের শিল্প নিয়ে: “যেন রাধাকৃষ্ণ-ভাবে উপনীত গান, কথায়ও বৈষ্ণব পদাবলীর ছাপ কাচ মরকত নবনী জড়িত/ কাঁচা মণিমুক্তো ননী জড়ানো সুকোমল তনু শ্যামল/ ও তার ভুরু দু’টি আঁকা ঈষৎ বাঁকা/ বাঁকা আঁখি দু’টি ঢলোঢলো।” তাঁর ওই রসিক (আনন্দ) উপন্যাসই নাটকের ভিত্তি, জানালেন নিদের্শক পার্থপ্রতিম দেব।
‘নাচনি’র একটি দৃশ্যে সোহিনী ও স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত।—নিজস্ব চিত্র।
নাটকে ধরা পড়েছে, কেমন মায়াময় এক জগত নাচনিদের শিল্পে পুরুলিয়ার পাষাণ জমিতে যেন প্রাণ এনে দেন তাঁরা। তাঁদের গান আর নাচের মুদ্রায় মানুষের কোমল হৃদয়বৃত্তি যেন ফুল হয়ে ফোটে, ভয়ঙ্কর খরা ভরা বর্ষা হয়ে ওঠে। প্রবীণা ও নবীনা দুই নাচনির চরিত্রে রয়েছেন স্বাতীলেখা সেনগুপ্ত আর সোহিনী সেনগুপ্ত। তাঁরা পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী, তাঁদের দুই রসিকের দ্বন্দ্বও টানাপোড়েন তৈরি করে নাটকে। কিন্তু যন্ত্রণাই আবার দুই নাচনিকে কাছে টেনে আনে। স্বাতীলেখার সংলাপ, ‘এ গানে বেদনা আছে রে বাপ, সে বেদনা বুকে চাপ্যে বেরিয়ে আসবে শুধু আনন্দ আর আনন্দ।’ আবার এমন সংলাপও আছে নাচনির পাশে একজন নাচনি না দাঁড়ালে আর কে দাঁড়াবে!
“নাচনিদের কাজ আগেও দেখেছি, কিন্তু এ বারের নতুন প্রযোজনার জন্যে ওঁদের একজনকে নিয়ে আসা হল, খুঁটিয়ে দেখলাম তাঁর পারফরম্যান্স,” বলেন স্বাতীলেখা। “কিন্তু কী জীবন নাচনিদের! তাঁদের রোজগারে রসিকদের সংসার চলে, অথচ তাঁদের সে সংসারে ঠাঁই মেলে না। মরার পর ডোম দড়ি দিয়ে ভাগাড়ে টেনে নিয়ে যায়।’’
মহাশ্বেতা দেবীও লিখছেন, “পশ্চিমবঙ্গে পুরুলিয়াতে নাচনি মেয়েদের মৃত্যু হলে, তাদের দাহ বা সমাধি হয় না। তার মৃতদেহ যায় ভাগাড়ে। বেজায় প্রগতিশীল রাজ্য সরকারের বেজায় প্রগতিশীল মহিলারা, পঞ্চায়েত স্তর থেকে মহিলা কমিশন অবধি যাঁরা দাপটে লেকচার দিয়ে বেড়ান, তাঁদের মনের চোখে গ্লুকোমা। কেন না তাঁরা নাচনিদের ন্যূনতম মানবাধিকার দেওয়ার কথা ভাবেন না।” একটি বইয়ের ভূমিকায় কথাগুলি লিখেছিলেন তিনি।
গত কয়েক বছরে কি কোনও বদল হয়েছে পরিস্থিতির?
যে বইয়ের জন্য কলম ধরেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী, সেটি হল নাচনির কথা (দুর্বার প্রকাশনী, পরিবেশন পুস্তক বিপণি)। লেখক দীপক বড়পণ্ডা। বইটি নাচনিদের সমাজজীবন ও শিল্পজীবনের একটি সমীক্ষা। লেখক ভূমিকায় লিখছেন, “যে নাচনি নৃত্যগীতের সৌরভে সৌন্দর্যে এত সংখ্যক মানুষ আকৃষ্ট হন সেই নাচগানের সঙ্গে যুক্ত নাচনিরা নিম্নবর্ণীয় হিন্দু ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের। মুচি, ডোম, কামার, জেলে, তাঁতি, সাঁওতাল প্রভৃতি জাতের মেয়েরাই নাচনি নাচগানের সাথে যুক্ত হন। কেউবা তাঁদের পিতা মাতার দারিদ্রের সূত্রে বিক্রি হয়ে যাওয়া, কেউবা অধিক বয়সেও বিবাহের সুযোগে বঞ্চিতা, কেউবা নারী পাচারকারীর শিকার, কেউ হয়ত বা স্বেচ্ছায় এসেছেন। অর্থাৎ প্রধানত সমাজের ব্রাত্য শ্রেণীর মানুষ।”
সমাজবিন্যাসে নাচনিদের ঠাঁইটা ঠিক কোথায়, এ আলোচনার সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও তুলেছেন দীপক: “এঁরা প্রকৃত শিল্পরসিক মানুষের কাছে অবশ্য ব্রাত্য হয়ে থাকেননি। এ কথাও সত্য যে, এই শিল্পরসিক মানুষেরা এখনও পর্যন্ত নাচনির প্রতি সামাজিক অন্যায় ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ গড়ে তোলেননি।”
নান্দীকারের ‘নাচনি’ কি পারবে সে প্রতিবাদের ভাষা গড়ে দিতে? কলকাতা ছেড়ে বেরিয়ে নান্দীকার যদি জেলায়-জেলায় মঞ্চস্থ করতে পারে এ-নাটক, তবেই হয়তো তা সম্ভব।

একটি অনুষ্ঠানের ফাঁকে থাঙ্কমণি কুট্টির সঙ্গে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা। শুক্রবার। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.