এ ভাবেও ফিরে আসা যায়!
চার বছর অনেকটা সময়। ক্যানসারের মতো ভয়াবহ রোগের আক্রমণ, তার চিকিৎসার জেরে জিভের অর্ধেকটা বাদ চলে যাওয়া, যে রবীন্দ্রনাথের গান ছিল একাধারে নেশা ও পেশা, তাকে হারানো, ফিরে পাওয়া এবং শেষে সুস্থ হিসেবে চিকিৎসকদের ছাড়পত্র। চার বছরের এক দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে সবটাই ফিরে পেলেন অনিতা দাস। তাঁর গান, তাঁর আত্মবিশ্বাস, চিকিৎসকদের প্রতি ভরসা সবই।
২০০৯ সালে জিভের ক্যানসারে আক্রান্ত হন অনিতা। রবীন্দ্রসঙ্গীতের শিক্ষিকা অনিতার জিভের অর্ধেকটাই বাদ গিয়েছিল অস্ত্রোপচারে। তার পরেও তাঁর গান গাওয়ার ইচ্ছাটা দিবাস্বপ্ন মনে করেছিলেন সকলেই। অস্ত্রোপচারের পরে জিভের কাটা অংশ মুড়ে সেলাই করে দেন চিকিৎসকেরা। ক্যানসার জিভের আশপাশেও ছড়াতে পারে, এই আশঙ্কায় গলার আশপাশের প্রচুর গ্ল্যান্ডও বাদ দেওয়া হয়। তার পরে গলা দিয়ে স্পষ্ট স্বর বেরোতো না। বহু চেষ্টায় কিছু শব্দ উচ্চারণ করা সম্ভব হলেও তা বুঝতেন না কেউ। সেই জায়গা থেকে লড়াইটা খুব সহজ ছিল না। কিন্তু অনিতা নিরন্তর চেষ্টা করে যেতেন। এ ভাবেই কেটে যেত মাসের পর মাস। অবশেষে এক দিন যখন গুনগুন করে রবীন্দ্রনাথের গানের কয়েক কলি গাইতে পারলেন, চমকে উঠেছিলেন তাঁর স্বামী ও মেয়ে। তাঁরাও যেন ব্যাপারটা বিশ্বাস করে উঠতে পারছিলেন না। ছুটে যান হাসপাতালে। ডাক্তারদের সামনে বসে গাইতে গাইতে অঝোরে কেঁদেছিলেন অনিতা। |
সেই অভিজ্ঞতাটাই জীবনের সেরা মুহূর্তগুলোর অন্যতম হয়ে রয়েছে শল্যচিকিৎসক শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। বর্তমানে কলকাতা ছেড়ে ম্যাঞ্চেস্টারে আছেন শমীক। আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের সে দিনের অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ছিলেন তিনি। বললেন, “সরকারি হাসপাতালের পরিষেবা নিয়ে এত সমালোচনা, এত নিন্দা। সে দিন মনে হয়েছিল, আমরা পারি, আমরাই পারি! আর অনিতাদেবীর নিজের জেদটাও এ ক্ষেত্রে খুব সাহায্য করেছিল আমাদের।”
চার বছর নিয়মিত ফলো আপের পরে সম্প্রতি চিকিৎসকেরা জানান, আর ভয় নেই, অনিতা দেবী এখন সম্পূর্ণ সুস্থ। গানের শিক্ষকতা, বিভিন্ন জায়গায় গানের অনুষ্ঠান সবই ফের শুরু করেছেন।
ক্যানসার শল্যচিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায় বলেন, “নিঃসন্দেহে এটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। আমরা ‘কোয়ালিটি অফ লাইফ’-এর উপরে সব সময়ে গুরুত্ব দিই। চিকিৎসা তখনই সফল হয়, যখন রোগী শুধু বেঁচে থাকার পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনে থাকতে পারেন। ক্যানসার চিকিৎসার অন্তিম সাফল্য এটাই।”
জানবাজারের বাড়িতে বসে পঞ্চাশ ছুঁইছুঁই মহিলা শোনাচ্ছিলেন চিকিৎসার অভিজ্ঞতার কথা। জিভে ঘা হয়েছিল। সারছিল না। কাজ হচ্ছিল না কোনও অ্যান্টিবায়োটিকেই। শেষে ধরা পড়ল, রোগটা ক্যানসার। চিকিৎসকেরা বললেন, জিভ বাদ দিতে হবে। শুনেই বেঁকে বসেন অনিতা। তাঁর কথায়, “জিভ বাদ পড়া মানে গান বন্ধ হয়ে যাওয়া। মনে হয়েছিল, তা হলে বেঁচে থেকে লাভ কী? কিন্তু আমার স্বামী, মেয়ে, ডাক্তারবাবুরা ক্রমাগত বোঝাতে শুরু করলেন। শেষ পর্যন্ত আমি অস্ত্রোপচারে রাজি হলাম।”
অস্ত্রোপচারের ঠিক আগেই ধরা পড়ল ডায়াবেটিস আর হাইপোথাইরয়েড। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল হল। কিন্তু চিকিৎসকেরা স্থির করলেন, পিছোবেন না। আর জি করে আট ঘণ্টা ধরে চলল অস্ত্রোপচার। অপারেশন থিয়েটার থেকে আইসিইউ, সেখান থেকে সাধারণ শয্যা কী ভাবে যে ঘোরের মধ্যে দিনগুলো কেটেছিল, এখন যেন ভাল করে মনেও করতে পারেন না অনিতা। চিকিৎসকেরা স্পিচ থেরাপি করাতে বলেছিলেন। অনিতার স্বামী সুবীর দাস বলেন, “আমি ওকে বলেছিলাম, তুমি নিজে চেষ্টা করো। ও এক মুহূর্ত থেমে থাকেনি। সব সময়ে চেষ্টা চালাত। ডাক্তারবাবুরাও সব সময়ে উৎসাহ দিতেন। তার পর কী করে যেন অসম্ভবটা সম্ভব হল।” অনিতার কথায়, “ডাক্তারদের সম্পর্কে বহু মানুষের খারাপ অভিজ্ঞতার কথা শুনি। কিন্তু আমাকে ওই সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারবাবুরাই নতুন জীবন দিয়েছেন। সেই ঋণ কখনও শোধ হওয়ার নয়।”
বিছানায় হারমোনিয়ামটা নিয়ে একমনে গাইছিলেন “আজি প্রণমি তোমারে চলিব নাথ...।” জীবনের উপরে বিশ্বাস হারাননি অনিতা। |