পুস্তক পরিচয় ১...
ফের সেই ভবঘুরে মহাশিল্পীর কাছে
মাই চ্যাপলিন, মৃণাল সেন। নিউ এজ, ৩৭৫.০০
ভারতীয় মানবমুখী চলচ্চিত্রের অন্যতম অগ্রপথিক মৃণাল সেনের বয়স গত ১৪ মে আরও এক বছর কমল। বিশিষ্ট মুক্তমনা ইতালীয় চিন্তাবিদ এলিয়ো ভিত্তোরিনির একটি উদ্ধৃতি মৃণালবাবুর অতি প্রিয়: ‘দ্য পয়েন্ট ইজ নট টু পকেট দ্য ট্রুথ বাট টু চেজ দ্য ট্রুথ।’ সম্প্রতি কিছু দিন হল ছবির মাধ্যমে ‘সত্যকে তাড়া করা’ সম্ভব হয়ে ওঠেনি বলে ছটফট করেছেন, আর অবশেষে লিখেছেন এমন এক চলচ্চিত্রকারকে নিয়ে দুটি বই, যিনি সত্যকে তাড়া করেছেন সম্ভবত সবচেয়ে বেশি। প্রথমটি বাংলায় চার্লিচ্যাপলিন; দ্বিতীয়টি ইংরেজিতে মাইচ্যাপলিন, যেটি আমাদের বিবেচ্য।
১৯৫৩-য় যখন চ্যাপলিনের বয়স ৬৪, তরুণ মৃণাল লিখেছিলেন তাঁকে নিয়ে প্রথম বই, প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন ফিল্ম সোসাইটিতে প্রায়শই দেখা হওয়া এক চিত্রশিল্পী, যাঁর নাম সত্যজিৎ রায়। তার পর নিজেকে এবং কথনকাঠামোকে ভেঙেচুরে কানে-পেনসিল চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের তোয়াক্কা না করে, ভারতীয় চলচ্চিত্রের এক সম্পূর্ণ আলাদা বয়ান তৈরি করার পর আবার ফিরে এলেন সাত বছর বয়সে প্রথম দেখা সেই ভবঘুরে মহাশিল্পীর কাছে, যিনি তাঁকে সীমাহীন ভাবে উত্তেজিত করেছেন।
খুব সাধারণ, ভবঘুরে একটি লোক। আ ব্লোক কলড চ্যাপম্যান, ক্যাপলিন অর সামথিং। আমরা যখন এক মৃত্যু-অববাহিকার দিকে ভেসে যাচ্ছি, তখন সেই ‘ব্লোক’-এর মুখোমুখি মৃণাল সেন। পরস্পরের মধ্যে একাকার হয়ে যাচ্ছেন দুই পার্শ্বরেখায়িত মানুষের পাঁচালিকার। খুব সহজে এক আবহমান খুদে ট্র্যাম্প ঢুকে পড়ছেন মৃণাল সেনের ছবির পর্দায় তাঁর ডারবি আর গোঁফ নিয়ে। নির্জন এক সাঁকোর উপর এক প্রতিবাদী চিত্রকরের সঙ্গে দেখা হচ্ছে এক জীবনশিল্পীর। চ্যাপলিনের মুখে সেই ঈষৎ অপ্রতিভ হাসি, যা ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের ব্যক্তিগত গ্লানি আর অপমানমালা।
পিপল লাফ অ্যান্ড থিঙ্ক অ্যান্ড গ্রো অ্যান্ড জাজ।
যিনি বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নোন হিউমিলিয়েশন। অ্যান্ড হিউমিলিয়েশন ইজ আ থিং ইয়ু ক্যান নেভার ফরগেট’, ‘ভাঁড়’ থেকে এক ‘নতুন মানুষ’ হয়ে ওঠা সেই ‘ব্লোক’-এর শুধু অভিব্যক্তি নয়, পোশাক হয়ে ওঠে সংকেতময়। ‘মাই কস্টিউম হেল্পস মি টু এক্সপ্রেস মাই কনসেপ্ট অব দি অ্যাভারেজ ম্যান, অব অলমোস্ট এনি ম্যান, অব মাইসেল্ফ।... হি ইজ ট্রাইং টু মিট দি ওয়ার্লড ব্রেভলি টু পুট আপ আ ব্লাফ অ্যান্ড হি নোজ দ্যাট টু। হি নোজ ইট সো ওয়েল দ্যাট হি ক্যান লাফ অ্যাট হিমসেল্ফ অ্যান্ড পিটি হিমসেল্ফ আ লিট্ল।’ মা আর ছেলে কী ভাবে চারপাশের রগড় দেখে হাসতে ভালবাসতেন, তার বিবরণ দিয়েছেন মৃণাল সেন। হানা চ্যাপলিনের মৃত্যুর আগের দিনও নার্সিং হোমে তাঁদের হাসতে দেখা যায়।
সরলরৈখিক উপস্থাপনা ভেঙে মৃণাল সেন সহজে একটি শিল্প-পরিসর থেকে অন্য পরিসরে হেঁটে যান। যাঁরা আঁদ্রে বাজ্যাঁ, মরিস বেসি, স্টিভ ভাইসম্যান বা ডেভিড রবিনসনের চ্যাপলিন বিষয়ক বই পড়েছেন, অথবা চ্যাপলিনের আত্মকথা, তাঁরাও এই বইটি পড়ে কম আনন্দ পাবেন না। এই বইয়ের ফুরফুরে মেজাজ তাঁর অন্য সমস্ত বইকেও ছাপিয়ে গিয়েছে, যেন তিনি ক্যামেরাকে কলম হিসেবে ব্যবহার করার মজাটা পুরোদস্তুর পেয়ে গিয়েছেন। ‘ম্যসিয়ো ভের্দু’র কথা বলতে গিয়ে হঠাৎ হিরোশিমা-নাগাসাকির বর্ণনায় (‘স্প্রলিং রুইন্স’-এর ভেতর এক ভয়ার্ত বালকের প্রতিমূর্তি) ইন্টারকাট করে চলে আসেন মৃণাল। ‘লাইমলাইট’-এ কালভেরোর আত্মকথা বলতে গিয়ে আত্মজীবনীর প্রশ্ন আসে। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর নিজের ছবি ‘একদিন আচানক’ প্রসঙ্গে ভেনিস উৎসবে জনৈক সমালোচকের আত্মজীবনী সংক্রান্ত প্রশ্নে চলে যান লেখক। আবার ‘লাইমলাইট’-এ ফিরে আসেন। ‘এ কাউন্টেস ফ্রম হংকং’-এর বসলি ক্রাউদার-কৃত নির্দয় সমালোচনা থেকে এক মুহূর্তে ‘পথের পাঁচালি’ সম্পর্কে ক্রাউদারের অকরুণ ও পাঁচ দিন পরে ভোল-বদলানো পরিশোধিত মন্তব্যে চলে যান। সত্যজিৎ রায়ের চ্যাপলিন-পাঠের সঙ্গে তাঁর পার্থক্যের কথা এত সূক্ষ্ম ও বিনীত সম্ভ্রমের সঙ্গে বলেন যে, চার পাশের কলতলার ক্লিন্ন কোলাহলকে কয়েক লহমার জন্য হলেও আমরা ভুলে যাই।
চ্যাপলিন-কন্যা জেরালডিন-কে ১৯৩৮-এ স্পেনীয় গৃহযুদ্ধের ওপর তাঁর পিতার এক রচনার কথা বলে চমকে দেন ‘ভুবন সোম’ আর ‘কলকাতা ৭১’-এর পরিচালক। জাতীয় গ্রন্থাগারে খুঁজে পাওয়া ‘Rhythme’ নামে নাতিদীর্ঘ যুদ্ধ-বিরোধী চিত্রনাট্য এই গ্রন্থের সম্পদ। এটি ফরাসি অনুবাদের ইংরেজি ভাষান্তর, মূল রচনাটির হদিশ মেলেনি।
১৯৭২-এর ৩ সেপ্টেম্বর গোঁফ, টুপি, ছড়িহীন বৃদ্ধ চ্যাপলিনকে একবারই দেখেছেন মৃণাল সেন। দর্শকদের সামান্য চুম্বন-বর্ষণ করে চেয়ারে এলিয়ে পড়েন তিনি।
শেক্সপিয়ার, রেনোয়া, ইলিয়া এরেনবুর্গ, বার্নার্ড শ, রবীন্দ্রনাথ, আইনস্টাইন, নোগুচি, পিকাসো, টমাস মান, ম্যাক্স লিন্ডার, নেহরু ও চার্চিলের নামও এসেছে। তবে সবচেয়ে মর্মস্পর্শী বর্ণনা চ্যাপলিন আর গাঁধীর সাক্ষাতের। ১৯৩১-এর সেপ্টেম্বরে চ্যাপলিন তাঁর সাক্ষাৎকার প্রার্থনা করেন। এ বইতে আছে গাঁধীর ভদ্রতা ও সহজ আত্মমর্যাদার কথা, আছে তাঁদের দু’জনের সংলাপ শুনতে অকল্পনীয় জন-ঔৎসুক্যের ছবি। তবে এই ব্যতিক্রমী আলেখ্য সবচেয়ে সার্থক হয়ে ওঠে আকবর নামে ফরিদপুরের ভবঘুরে এক বালকের কাহিনিতে। তাঁকে মৃণাল সেন প্রথম দেখেন ফরিদপুরের টেনিস কোর্টে বল কুড়োতে। জুতো পালিশেও হাত লাগিয়েছিল সে। ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’-এর মিছিলেও হাঁটতে দেখেছিলেন তাকে। পরে কলকাতায় এসে গীতা সেনের কাছে একটি কম্বল উপহার পেয়ে, তার ‘অপূর্ব চোখের’ প্রতি মুগ্ধতা জানিয়ে সে দুটি ট্রামের নীচে পিষ্ট হয়ে মারা যায়। ছয় দশক আগে বিশ্ব চলচ্চিত্রের আবহমান ভবঘুরে চ্যাপলিনকে নিয়ে লেখা তাঁর প্রথম বইটি আকবরকে উৎসর্গ করেছিলেন তরুণ মৃণাল সেন। এক দীর্ঘ পথ-পরিক্রমার শেষে আজ সেই সমাজ-বহির্ভূত আকবরই চ্যাপলিনকে নিয়ে তাঁর সর্বোত্তম বইটিকে এক অব্যক্ত যন্ত্রণায় রক্তদীপময় করে তুলেছে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.