বদলে গিয়েছে জামার রং, দিন বদলায়নি
বিরোধীদের প্রার্থী নেই, সন্ত্রাসের
কথাও নেই পাল্টে যাওয়া রায়নায়
তৃণমূল নেতা বলেই দিয়েছিলেন, ‘কোথাও কোনও সন্ত্রাসের গল্প পাবেন না। ঘুরে দেখুন না!’
কথাটা ঠিকই।
চায়ের দোকানে বসে সন্ত্রাসের কথা তুললে পাশের লোক আধ কাপ চা ফেলে উঠে যান। দূরে মোটরবাইক আসতে দেখে হাওয়া মিলিয়ে যায় পথ-আলাপী মানুষ। ভয়ে হোক বা নতুন শাসকদলের প্রতি ভক্তিতে, রায়নায় এই মুহূর্তে সিপিএমের হয়ে কথা বলার লোকই নেই।
‘সন্ত্রাসের গল্প’ শুনতে চাইলে তাই রায়নার পথে-ঘাটে ঘুরে খুব লাভ নেই। বিশেষ করে রায়না ২ ব্লকে, যেখানে গত বার ১০৬টি পঞ্চায়েত আসনের (একটা বড় অংশে প্রার্থীই দিতে পারেনি) মোটে দু’টি পেয়েছিল তৃণমূল, বাকি সব সিপিএম। পঞ্চায়েত সমিতির ২২টি এবং জেলা পরিষদের দু’টি আসনেও শুধু সিপিএম। সেখান থেকে জিতেই উদয় সরকার এখনও বর্ধমানের জেলা সভাপধিপতি।
এর পরে শুধু লোকসভা নির্বাচন নয়, পরিবর্তনের বিধানসভা ভোটেও রায়নার ওই এলাকায় ৫০ শতাংশের বেশি ভোট ধরে রেখেছিল বামেরা। শুধু উদয়বাবু নন, সিপিএমের বর্ধমান জেলা সম্পাদক অমল হালদার এবং বর্ধমানের পুরপ্রধান আইনূল হকেরও গ্রামের বাড়ি ওই ব্লকেই। অথচ এ বার ১১৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত আসনে মাত্র ৩০ জন প্রার্থী দাঁড় করাতে পেরেছে সিপিএম। পঞ্চায়েত সমিতিরও মোটে অর্ধেক আসনে তারা টিকে রয়েছে।
কেন? তুমুল সন্ত্রাস হচ্ছে?
শুক্রবার সকালে কাইতি গ্রামে রাস্তার পাশে চায়ের দোকানে বসে কথাটা তুলতেই আধখাওয়া চায়ের কাপ ফেলে উঠে চলে গেলেন পাশের ভদ্রলোক। এবং দোকানদার উঠে এসে বললেন, “আমার দোকানে রাজনীতি নিয়ে কথা বলবেন না। ওরা ভাবতে পারে, আমিও সিপিএম।” উদয়বাবুর বদলে তাঁর রায়না ২/৯ আসনে যিনি দাঁড়াচ্ছেন, সেই আব্দুল হান্নান এই কাইতিরই লোক। সদ্য বর্ধমান দক্ষিণ মহকুমাশাসকের কাছে মনোনয়ন দিয়ে তিনি আর গ্রামে ফিরতে পারেননি। মনোনয়ন দিয়ে ফেরেননি দুর্গাবাটীর মহিলা প্রার্থী কাকলি মণ্ডলও ইতিউতি চেয়ে নিচুগলায় জানিয়েই সরে যান দু’এক জন।
সকাল থেকে রায়না ২ ব্লকের মাধবডিহি থানা এলাকা চষে ফেলেও মাত্র কয়েক জনকেই কথা বলানো গিয়েছে। বর্ধমান-আরামবাগ রাস্তায় সগড়াই মোড়ে পার্টি অফিসে বসে সিপিএমের রায়না জোনাল সম্পাদক মির্জা আখতার আলি অভিযোগ করেন, “বিধানসভা ভোটের পর থেকেই রায়নার দু’টি ব্লকে তৃণমূলের সন্ত্রাস চলছে। ২৪টা নম্বরবিহীন বাইক নিয়ে ওরা বাইকবাহিনী তৈরি করেছে। একটার পর একটা গ্রাম দখল করে চলেছে। আমরা অসহায়!”
পহলানপুর পঞ্চায়েতের পথে ঘুরে বেড়ালে শোনা যায়, মনোনয়ন দিয়ে গ্রামে ফিরেছিলেন সিপিএম প্রার্থী শেখ কাদের খান। মঙ্গলবারই তাঁকে ও তাঁর প্রস্তাবক শেখ শামিম আলিকে মারধর করে ফতেপুর গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তাঁর দুই ছেলে কামাল ও আমির তৃণমূলের ভয়ে মেদিনীপুরের চন্দ্রকোনা রোডে মামারবাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু তাঁদের গ্রামেও সকলের মুখে কুলুপ। কাদের আর শামিমকে মারধর করা হয়েছিল? খেতের আলে বসে থাকা এক জন বলে ওঠেন, “ওদের তো গরুচোরের মতো মারা হয়েছে। নিজের চোখে সব দেখেছি। কিন্তু টুঁ শব্দটি করতে পারিনি বাইকবাহিনীর দাপটে!”
আপনার নাম? উত্তর নেই।
সিপিএমের একদা শক্ত ঘাঁটি উচালন থেকে রায়না-২ পঞ্চায়েত সমিতিতে দলের প্রার্থী হয়েছেন কোহিনুর বেগম। কিন্তু তিনি কোথায়, সে ব্যাপারে কেউই কোনও কিছু বলতে নারাজ। এক বৃদ্ধ প্রায় কানের কাছে মুখ এনে শুধু বলেন, “উকে তো ইলাকা থেকে তাইড়ে দেইচে তৃণমূলির নোকেরা!” গ্রামে আসা সাংবাদিক-আলোকচিত্রীকে দেখে ভিড় করেছিলেন কয়েক জন। দূর থেকে ধুলো উড়িয়ে বাইক আসতে দেখে সকলেই সরে গেলেন। তফাতে গিয়ে অপলক চোখে গাছের পাতা গুনতে লাগলেন সেই বুড়োও।
দু’বছর আগেও যেখানে সিপিএমের কথা ছাড়া গাছের পাতা খসত না, সেখানে এই হাল হল কী করে? নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলের জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, “আমাদের শ’য়ে-শ’য়ে কর্মী-সমর্থক গ্রামছাড়া। লক্ষ-লক্ষ টাকা জরিমানা দিতে হয়েছে। কোনও দিন সিপিএম করবেন না এই কড়ারে অনেকে গ্রামে থাকতে পারছেন।” রায়নার সিপিএম বিধায়ক বাসুদেব খাঁ এখন প্রায় মসনদ হারানো সম্রাটের ভূমিকায়। ৮৯টি আসনে প্রার্থী দেননি কেন জানতে চাইতেই প্রায় খ্যাঁক করে ওঠেন, “কী করে দেব? গত দু’বছরে আমাদের কোনও প্রকাশ্য সভা করতে দেয়নি পুলিশ। মাধবডিহি থানায় কোনও অভিযোগই নেয় না। উল্টে তৃণমূলের মিথ্যে অভিযোগে আমাদের লোকেদের গ্রেফতার করে।”
বর্ধমানের পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা অবশ্য বলেন, “নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই আমরা ব্যবস্থা নিয়েছি। কেউ মনোনয়ন জমা দিতে বাধা পাচ্ছেন বলে জানালেই তাঁকে পাহারা দিয়ে ব্লক অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।” তৃণমূল নেতা শৈলেন সাঁইয়ের ব্যাখ্যা, “আসলে সিপিএমের নেতারা মানুষের উপরে প্রবল অত্যাচার করেছে বলেই ওদের হয়ে কেউ ভোটে দাঁড়াতে চাইছে না।” বাসুদেববাবু অবশ্য চ্যালেঞ্জ ছোড়েন, “শুধু পুলিশ সরে যাক, দেখিয়ে দেব, মানুষ আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন!”
২০০৮ সালে যা-ও বা তৃণমূল ‘লালদুর্গ’ বর্ধমানে একটু-আধটু মাথা তুলেছিল, তার আগের বার পরিস্থিতি ছিল একেবারে উল্টো। ২০০৩ সালে গোটা জেলায় সিপিএমের বিরুদ্ধে মনোনয়ন জমা করতে না দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিল কংগ্রেস-বিজেপি-তৃণমূল। বহু আসন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ছিনিয়ে নেয় তৎকালীন শাসক গোষ্ঠী। তখন সিপিএমের নেতারা বলতেন, ‘প্রার্থী খুঁজে না পেয়ে ওরা এই সব গালগল্প ফাঁদছে।’ অমলবাবু টিপ্পনী কেটেছিলেন, “ওরা প্রার্থী পাচ্ছে না বলে তো আর আমরা ওদের হয়ে প্রাথী দাঁড় করিয়ে দিতে পারি না!”
সেই সময়ে উদয়বাবুর আশ্বাস ছিল, “ওঁদের প্রার্থীরা মনোনয়ন দিতে পারছেন না বলে আমাদের জানালে, আমরা নিয়ে গিয়ে জমা করিয়ে দেব।” কয়েক দিন আগে তৃণমূলের জেলা সভাপতি (গ্রামীণ) তথা মন্ত্রী স্বপন দেবনাথ ঠিক একই আশ্বাস দিয়েছেন।
পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে দশ বছর বোধ হয় অনেকটা সময়।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.