|
|
|
|
জঙ্গলমহলে ফের হুমকি-রাজ |
দাদারা আসছে, ভোটে দাঁড়ালে দেখে নেব |
সোমনাথ চক্রবর্তী ও কিংশুক গুপ্ত • মেদিনীপুর |
কোথাও শাসকদলের প্রথম সারির নেতাকে ফোন করে খুনের হুমকি। কোথাও বিধায়ককে তোলা চেয়ে ধমকি-ফোন। এ সব ছাপিয়ে পঞ্চায়েত ভোটের মুখে শুরু হয়েছে বাড়ি বয়ে এসে শাসানি। যার মোদ্দা কথা, ভোটে প্রার্থী দিলে প্রাণ খোয়াতে হবে।
মাওবাদী ও তার দোসরদের এই রক্তচক্ষু দেখে পশ্চিমবঙ্গের ওড়িশা-ঝাড়খণ্ড সীমানাবর্তী জঙ্গলমহলে শাসকদলের মন্ত্রী-বিধায়ক-নেতারা কার্যত ভয়ে কাঁটা হয়ে রয়েছেন। আতঙ্কের পারদ আরও চড়িয়েছে সম্প্রতি ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদী-হানাদারির ঘটনা। তৃণমূল নেতৃত্বের অভিযোগ: সিপিএমকে সাহায্য করতেই মাওবাদীরা সন্ত্রাস ছড়াচ্ছে। বিরোধীদের পাল্টা দাবি: তৃণমূল এখন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মাসুল দিচ্ছে।
সব মিলিয়ে নতুন আতঙ্কের আবহে আবার যেন ঢাকা পড়ছে জঙ্গলমহল। সরকারি বিজ্ঞাপনের বয়ান অনুযায়ী জঙ্গলমহল হাসলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সরকারের দু’বছরের মধ্যে সে হাসি মিলিয়ে যাওয়ার লক্ষণ ফুটে উঠছে! কী রকম? |
|
সম্প্রতি পশ্চিম মেদিনীপুরে নয়াগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক দুলাল মুর্মুকে ফোন করে তোলা চাওয়া হয়েছিল। দু’জন ধরা পড়ে, যাদের এক জন গজেন মুর্মু পুলিশের খাতায় ‘মাওবাদী’ ছাপ্পা মারা। বিধায়কেরও তাই মত। মাওবাদী স্কোয়াড-নেতা কাঞ্চনের ভূমিকাও যাচাই করছে পুলিশ। তৃণমূল নেতারা পুলিশকে জানিয়েছেন, নয়াগ্রামে ইদানীং কিছু বহিরাগতের আনাগোনা চলছে। পুলিশ গ্রামে-গ্রামে তল্লাশি চালাচ্ছে। আগে নয়াগ্রাম ব্লকের তৃণমূল সভাপতি উজ্জ্বল দত্তকে ফোনে খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। ফোন পেয়েছেন স্থানীয় আরও কিছু নেতা-কর্মী।
তবে সব ছাড়িয়ে গিয়েছে পঞ্চায়েতে প্রার্থী না-হওয়ার ফতোয়া। তৃণমূল-সূত্রের খবর, সম্প্রতি নয়াগ্রামে জনা দশ-বারো অপরিচিত যুবক বিধায়কের ঘনিষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে দেখা করে পরিষ্কার জানিয়ে এসেছে, সীমানাবর্তী গোপীবল্লভপুর ৪ ও ৭ নম্বরে তৃণমূলের কোনও প্রার্থী যেন না-দাঁড়ায়। কারণ, সেখানে ‘পছন্দের’ লোককে নির্দল প্রার্থী করবে মাওবাদীরা। দুলালবাবুর অভিযোগ, “কিছু দিন ধরে ওড়িশা-ঝাড়খণ্ড থেকে আসা কিছু লোক আমাদের হুমকি দিয়ে বলছে, দাদারা (মাওবাদীরা) আসছে। তোমরা ভোটে দাঁড়ালে ফল ভাল হবে না। দেখে নেব।’’
শুনে স্বভাবতই নিচু তলায় আতঙ্ক ছড়িয়েছে। তৃণমূল সাংসদ তথা জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত শুভেন্দু অধিকারীর বক্তব্য, “সব জেনেছি। ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। মাওবাদীরা বেলপাহাড়ি-নয়াগ্রাম-গোপীবল্লভপুরে সিপিএম-কে মদত দিচ্ছে। তাই চেষ্টা করছে, আমাদের লোক যাতে প্রার্থী হতে না পারেন।” হুমকিগুলোকে তাঁরা ধর্তব্যের মধ্যে আনছেন কি?
মাওবাদীদের ‘কাপুরুষের দল’ আখ্যা দিয়েও শুভেন্দুবাবুর স্বীকারোক্তি, “ঝুঁকি তো থেকেই যায়!” সাংসদ জানাচ্ছেন, “বিক্রম ধরা পড়ার পরে ওরা কিছু দিন চুপ ছিল। ক’দিন আগে অযোধ্যা পাহাড়ের উরমা ও খুনটাঁড় গ্রামে পোস্টার দিয়েছে। বাঁকুড়ায় আসা-যাওয়া করছে। বান্দোয়ান দিয়ে ঢুকে সিমলাপাল-মুকুটমণিপুরে যাচ্ছে।”
নব উদ্যমে মাওবাদী গতিবিধির খবরে শাসকদলের মতো পুলিশও উদ্বিগ্ন। বিশেষত ছত্তীসগঢ়-হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূলের মন্ত্রী-বিধায়ক-নেতাদের পুলিশের তরফে নানা ভাবে সতর্ক করা হচ্ছে। বলা হয়েছে, পুলিশকে না-জানিয়ে ওঁরা যেন সভা-সমাবেশ না-করেন। মাওবাদী খতম-তালিকায় থাকা নেতাদের প্রতি পরামর্শ: সূর্যাস্তের আগে বাড়ি ঢুকে পড়ুন। ব্যক্তিগত নিরাপত্তা জোরদার হয়েছে। দলীয় সূত্রের খবর: বিধায়ক দুলালবাবুর সঙ্গে সর্বক্ষণ থাকছেন চার জন রক্ষী, বাড়িতেও কড়া প্রহরা। তৃণমূল নেতা চূড়ামণি মাহাতো ও শালবনির বিধায়ক শ্রীকান্ত মাহাতোকে চার জন করে রক্ষী দেওয়া হয়েছে। জেলার নেতা দীনেন রায়ও রয়েছেন রক্ষী-ঘেরাটোপে।
নিরাপত্তার বাড়তি বহর দেখে আতঙ্ক তো কমেইনি, বরং কিছুটা বেড়ে গিয়েছে। আমজনতা থেকে রাজনৈতিক কর্মী বিভিন্ন মহলের কথাবার্তায় উঠে আসছে পঞ্চায়েত নির্বাচন ঘিরে মাওবাদী সক্রিয়তারপ্রসঙ্গ। সরকারের দু’বছরের মাথায় এমন উল্টো ছবি কেন?
জঙ্গলমহলে কান পাতলে নানা ব্যাখ্যাও মিলছে। প্রশাসন, বিরোধী, এমনকী তৃণমূলের একাংশের মুখেও ‘শত্রুর শত্রু, আমার মিত্র’ নীতি নিয়ে চর্চা হচ্ছে আড়ালে-আবডালে। অভিযোগ: গত বিধানসভা ভোটের আগে সিপিএম-কে হারাতে তৃণমূল জঙ্গলমহলে এই নীতি আঁকড়েছিল, বোঝাপড়া করে মাওবাদী-ছত্রচ্ছায়ায় থাকা জনসাধারণের কমিটির সঙ্গে।
কিন্তু মাওবাদীরা তো বটেই, তৃণমূলে মিশে যাওয়া জনগণের কমিটির প্রাক্তন নেতাদের একাংশের অভিযোগ, ওই কৌশলে ভোট-বৈতরণী পেরিয়ে ক্ষমতা দখলের পরে মমতা-সরকার কমিটির জেলবন্দি নেতাদের নিঃশর্ত মুক্তি ও যৌথবাহিনী প্রত্যাহারের প্রতিশ্রুতি পালন করেনি। যার পরিণতিতে ২০১১-র অগস্ট-সেপ্টেম্বরে ঝাড়গ্রামে দুই তৃণমূল কর্মী-সহ তিন জনকে খুন করেছিল মাওবাদীরা। তারই পরে যৌথবাহিনীর হাতে মারা পড়েন মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজি। শীর্ষনেতার মৃত্যুর পরে তো মোটামুটি শান্তই ছিল জঙ্গলমহল! ফের কী ভাবে সন্ত্রাস মাথা চাড়া দিচ্ছে? শাসকদল-সূত্রের ইঙ্গিত, ঝাড়গ্রাম মহকুমার নয়াগ্রাম ব্লকে তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের সুযোগেই মাওবাদী সক্রিয়তা বেড়েছে।
জনগণের কমিটির যে সব নেতা তৃণমূলে এসেছেন, তাঁদের সঙ্গে তৃণমূল ব্লক নেতৃত্বের বিরোধ বাড়ছে। দলীয় বিধায়ক ও ব্লক সভাপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। “দলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী চূড়ান্ত স্বজনপোষণ, আর্থিক অনিয়ম চালাচ্ছে। মিথ্যে নালিশ ঠুকে বিক্ষুব্ধদের হাজতে পোরা হচ্ছে। মাওবাদীরা এর ফায়দা লুটছে। লাভ হচ্ছে সিপিএমেরও।” আক্ষেপ স্থানীয় তৃণমূলের নিচুতলার কিছু কর্মীর।
রাজ্যে মাওবাদের ‘আঁতুড়ঘর’ লালগড়েও ছবিটা প্রায় এক। অভিযোগ, সেখানেও শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ধূমায়িত ক্ষোভের সুযোগ কাজে লাগাচ্ছে মাওবাদীরা। দলীয় সূত্রের খবর: ঝাড়গ্রামের বিধায়ক তথা পশ্চিমাঞ্চল উন্নয়নমন্ত্রী সুকুমার হাঁসদার সুপারিশে গরিবদের জন্য বরাদ্দ অধিকার প্রকল্পে বাড়ি তৈরির টাকা পেয়েছেন তৃণমূলের লালগড় ব্লক সভাপতি বনবিহারী
রায় ও স্থানীয় কিছু নেতার পরিজন। সম্প্রতি তা প্রকাশ্যে আসায় দলে ব্যাপক অসন্তোষ দেখা দেয়। তবু বনবিহারীবাবুকেই লালগড় ব্লকে পঞ্চায়েত ভোট পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছে দল। তা ক্ষোভে ইন্ধন দিয়েছে।
এবং অসন্তোষের এই জমিতেই মাওবাদীরা প্রতিপত্তির ভিত নতুন করে গাঁথতে চাইছে বলেমনে করছেন প্রশাসন-রাজনীতিকদের একাংশ। জেলা পুলিশেরও একাংশের অনুমান, রাজনৈতিক কর্মীদের নিশানা করে আতঙ্ক ছড়িয়ে তারা হারানো জমি ফিরে পেতে তৎপর। নয়াগ্রাম-লালগড়ের মতো ঝাড়খণ্ড লাগোয়া বেলপাহাড়ির শিমুলপালেও রাতে মাওবাদী স্কোয়াডের আনাগোনা চলছে বলে পুলিশ-সূত্রের খবর।
সব দেখেশুনে নয়াগ্রামের এক প্রবীণ সিপিএম নেতা বলছেন, “তৃণমূল এখন নিজেদের মধ্যে মারামারিতেই ব্যস্ত। আমরাও জমি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছি।”
যা শুনে জঙ্গলমহলের এক তৃণমূল নেতার মন্তব্য, ‘‘শত্রুর শত্রু, আমার মিত্র নীতিতেই এখন সিপিএম-মাওবাদী গলাগলি হয়েছে!”
|
মহেন্দ্র, নন্দকুমার-সহ কংগ্রেস নেতাদের খুনের দায় নিয়ে বিবৃতি দিল মাওবাদীরা। পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রী রমন সিংহ-সহ রাজ্য প্রশাসনের একাধিক শীর্ষ কর্তার নামে হুঁশিয়ারিও জারি করেছে তারা। ফলে নড়ে বসেছে ছত্তীসগঢ় প্রশাসন। গোয়েন্দাদের অনুমান, এ বছর বর্ষায় পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি থেকে নজর ঘোরাতেই সুকমায় কংগ্রেস নেতাদের উপরে হামলা চালিয়েছে মাওবাদীরা। সে কথা মাথায় রেখে মাওবাদী দমনের কৌশল বদলের কথাও ভাবছে কেন্দ্র। ছত্তীসগঢ় সরকারকেও সেই পরামর্শই দিয়েছে তারা। সঙ্গে চলছে রাজনৈতিক চাপানউতোর! |
|
পুরনো খবর: মাওবাদীদের হুমকি উড়িয়ে পাল্টা ‘লড়াইয়ের’ ডাক দিল জঙ্গলমহল |
|
|
|
|
|