|
|
|
|
|
|
|
অদৃশ্য! |
প্রতিবন্ধীদের বাসে-ট্রেনে ওঠার আলাদা ব্যবস্থা নেই, অফিসে
হুইলচেয়ারের ঢালু
র্যাম্প
নেই,
এটিএম মেশিন অবধি এমন উচ্চতায়, ওঁরা চেয়ারে বসে হাত পান না।
অবশ্য কী এসে যায়? ওঁরা তো ‘নেই-মানুষ’! লিখছেন পারিজাত বন্দ্যোপাধ্যায়।
|
জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে ‘ডিফমির্র্টি’ নামে একটা বই লিখেছিলেন উইলিয়াম হে। সালটা ১৭৫৪। উইলিয়াম উচ্চশিক্ষিত, ইংল্যান্ডের এলিট সমাজের মান্যগণ্যদের অন্যতম। তাঁর পাঁচ ফুট উচ্চতা, জন্ম থেকে পিঠ ধনুকের মতো বাঁকা। সমাজের যে উচ্চবিত্ত, রুচিবান, শিক্ষিত সমাজের অংশ ছিলেন তিনি, সেখানে সরাসরি কাউকে বিদ্রুপাত্মক কথা বলে অপমানিত করা এটিকেট-বিরুদ্ধ। তাও সারা জীবন এক রাশ লজ্জা নিয়ে, আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে কেটেছিল তাঁর। কারণ, তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত সমাজেরও তো অভদ্রতা আর অবজ্ঞার নিজস্ব ভাষা থাকে। উইলিয়ামের ‘অস্বাভাবিকতা’, শারীরিক বৈকল্যকে সেই ভাষার ছোবলে পড়তে হয়েছে আজীবন, পরিবারের ভিতরে এবং বাইরে। কখনও চাপা হাসি, কখনও দীর্ঘশ্বাস মেশানো করুণা ক্ষতবিক্ষত করেছে তাঁকে।
আসলে যুগযুগান্ত ধরে আমাদের চেতনার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে মহামারির মতো ছড়িয়ে আছে সুস্থতা, স্বাভাবিকতার ধারণা। যেটা ছকবাঁধা, সেটাই কাম্য, সেটাই গ্রাহ্য, সেটাই ‘স্বাভাবিক’। আর সামান্য বিচ্যুতি হলে, ‘অন্যরকমত্ব’ ঘটলেই তাকে বাতিল করো, দেখেও না দেখার ভান করো, বা বেমালুম লোপাট করে দাও। যেমন স্পার্টা-য় করা হত। রুগ্ন, প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্মমাত্র তাকে খতম করে ফেলা হত।
দক্ষিণ সুদানের নুয়ের জনজাতির মধ্যে এখনও এর চল রয়েছে। যোদ্ধা জাতির নিজস্ব সমাজে সন্তান বিকলাঙ্গ হলেই তাকে মরতে হবে। কোনও কাকুতি-মিনতির জায়গা নেই। প্রসবের পরে জনজাতির প্রধান শিশুকে পরীক্ষা করবেন। বিকৃতি দেখলে তাকে ছুড়ে ফেলা হবে জঙ্গলে, হাতির পায়ের নীচে কিংবা নীল নদের জলে। যুদ্ধ করে টিঁকে থাকার যুগ পেরিয়ে কৃষির বিকাশ হল, শিল্পবিপ্লব-ক্যাপিটালিজ্মের দাপট এল, তবু প্রতিবন্ধী মানুষের প্রান্তিকতা ঘুচল না। চাষের কাজ তাঁদের দিয়ে হচ্ছে না, কারখানায় উৎপাদন হচ্ছে না। অতএব, তাঁরা ‘ফালতু’। তাঁদের প্রতি দিনের চলাফেরা বা কাজ করার মতো পরিকাঠামো গড়া, তাঁদের পুনর্বাসন, শিক্ষা, সমানাধিকার সম্পর্কে নিরাসক্ত রাষ্ট্রকর্তারা।
মধ্যযুগীয় ইউরোপে প্রতিবন্ধী সন্তান জন্মালে মনে করা হত, বাবা-মা নিশ্চিত ব্ল্যাক-ম্যাজিক বা ডাইনিচর্চার সঙ্গে জড়িত, কিংবা মা শয়তানের সঙ্গে সহবাস করেছেন। অতএব, সারা জীবনের জন্য গোটা পরিবার অপরাধী, অভিশপ্ত চিহ্নিত হয়ে যেত। এখনও ভারতের বহু প্রান্তের মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস, প্রতিবন্ধী সন্তান হল বাবা-মায়ের পূর্বজন্মের পাপের ফল, কিংবা মায়ের শরীর বা পরিবারের জিনে কোনও লুকনো অসুখের ফসল। তাই এমন সন্তানের জন্মের সঙ্গে-সঙ্গেই মায়ের উপর শুরু হয় কম-বেশি শারীরিক-মানসিক নির্যাতন। আর সন্তানটি হয় অপাঙ্ক্তেয়। বহু পরিবার তাকে স্পেশাল স্কুলে ভর্তি করার খরচটুকুও দিতে নারাজ। প্রতিবন্ধী যত অচল হয়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকে তত যেন তাঁরা লজ্জা এড়াতে পারেন। সমাজ-রাষ্ট্রের কাছেও সে অপ্রয়োজনীয়। শারীরিক বা মানসিক অসুবিধার জন্য প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের ক্ষমতা, জোট বেঁধে দাবি আদায় বা বিক্ষোভের অবস্থাও থাকে না প্রতিবন্ধী মানুষগুলোর। পিছু হটতে-হটতে বহু সময় না-মানুষে পরিণত হন তাঁরা। |
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
দীপক চতুর্বেদীর কথা শুনবেন? ৩১ বছরের বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখের দীপক। মুম্বইয়ের এক সরকারি ব্যাঙ্কের অফিসার। ২২ বছর পর্যন্ত সব ঠিকঠাক ছিল। মেধাবী ছাত্র, এমবিএ করতে নামী বেসরকারি কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। আচমকা ধরা পড়ল রোগটা। মাসকুলার ডিস্ট্রফি। এতে মাংসপেশিগুলি আস্তে-আস্তে কর্মক্ষমতা হারায়। রোগীর এক-একটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিকল হতে থাকে। এখনও পর্যন্ত এই রোগ পুরোপুরি সারানোর কোনও ওষুধ নেই।
কয়েক মাসের মধ্যে সিঁড়ি দিয়ে ওঠা-নামা, দৌড়নোর ক্ষমতা হারালেন। বসলে উঠতে পারেন না, সামান্য ধাক্কায় টাল খেয়ে গড়িয়ে পড়েন। বেসরকারি কলেজ মনে করল, এই প্রার্থীকে কোনও সংস্থাই নিতে চাইবে না। শুধু শুধু একটা আসন নষ্ট করার মানে হয় না। অতএব কলেজ থেকে তাঁকে বের করে দেওয়া হল। হাল ছাড়লেন না দীপক। পরীক্ষায় বসে সরকারি ব্যাংকে চাকরি পেলেন প্রতিবন্ধী কোটায়। অথচ, মেডিকাল টেস্টে সেই ব্যাংকই তাঁকে ‘শারীরিক ভাবে অক্ষম’ বলে বাতিল করল। মামলা ঠুকলেন দীপক। জানতে চাইলেন, এক জন প্রতিবন্ধী কোটার প্রার্থীকে কী ভাবে ‘শারীরিক অক্ষমতা’র কারণে বাতিল করা হয়?
মামলার ঝামেলার ভয়ে সেই ব্যাংক তাঁকে চাকরি দিল বটে, কিন্তু ‘শিক্ষা দিতে’ মহারাষ্ট্রের এমন প্রত্যন্ত প্রান্তের শাখায় পোস্টিং দিল, যেখানে শারীরিক ভাবে সম্পূর্ণ সুস্থ মানুষও জেরবার হয়ে যাবে। চাকরি ছাড়তে বাধ্য হলেন দীপক। এ বার ব্যাংক-পিও পরীক্ষা দিয়ে সফল হলেন। ট্রেনিংয়ের জায়গা ঠিক হল বেঙ্গালুরুর এক বহুতলের পাঁচতলায়। সেখানে লিফ্ট নেই। প্রতি দিন দীপকের চার-পাঁচ জন বন্ধু তাঁকে পাঁজাকোলা করে উপরে নিয়ে যেতেন আর নামাতেন। দীপক বলছিলেন, ‘অন্যের উপর নির্ভর করব না বলে দাঁতে দাঁত চেপে পরিশ্রম করে চাকরিটা পেলাম। কিন্তু ট্রেনিং নিতে গিয়ে আত্মবিশ্বাস বাড়ার বদলে প্রতি দিন লোকের কোলে চড়ে পাঁচতলায় ওঠার সময় অসহায়তায় চুরচুর হতে লাগলাম। কত সহজে আমার পারিপার্শ্বিক আমাকে বুঝিয়ে দিল, আমি কতটা অকেজো।’ কোনও প্রতিবন্ধী লিফ্ট-বিহীন বহুতলে কী ভাবে উঠবেন এই কথা ওই প্রশাসনিক ভবন তৈরির আগে সরকারের কেষ্টবিষ্টুুদের এক বারও মনে হয়নি। স্থপতিদের এক বারও মনে হয়নি। ওখানে ট্রেনিং সেন্টার খোলার আগে দীপকদের কথা ভাবেননি ব্যাংক কর্তৃপক্ষও। এখানেই শেষ নয়।
মুম্বইয়ের এক ব্যাংকে চাকরি পেলেন দীপক। সেখানে চার-পাঁচটা সিঁড়ি ভেঙে ঢুকতে হয়। প্রতিবন্ধীদের কথা মাথায় রেখে সিঁড়ির পাশাপাশি র্যাম্প আমাদের দেশে হাসপাতাল ছাড়া আর কোথাও প্রায় বিরল। অতএব, সেখানেও রোজ সহকর্মীদের কোলে চড়ে ঢোকা এবং বেরনো। ব্যাংকের শৌচালয়ে ঢুকতেও তিনটে সিঁড়ি উঠতে হয়। যাতে শৌচালয়ে যেতে না হয় সেই জন্য দিনে প্রায় ১০ ঘণ্টা বাথরুম চেপে কাজ করেন দীপক। কাজ করতে-করতে একটু উঠে বাইরে থেকে ঘুরে আসবেন, সেটাও যথাসম্ভব এড়াতে চান। কারণ, বাইরে যাওয়া মানেই আবার কারও কোলে চড়া।
এই রকম শয়ে শয়ে ভুক্তভোগীর চিঠি প্রতি মাসে এসে পড়ে থাকে রাজ্য প্রতিবন্ধী কমিশনারের দফতরে। কোথাও শারীরিক প্রতিবন্ধীকে এমন জায়গায় চাকরি দেওয়া হয়েছে যেখানে প্রতি দিন তাঁকে বাস, ট্রেন, অটো বদল করে যেতে হয়। কোথাও প্রতিবন্ধী ভাই বা বোনকে প্রাপ্য সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, কোথাও বিকলাঙ্গ শিশু বা স্লো লার্নার শিশুকে সাধারণ স্কুল ভর্তি করতে চাইছে না, ভর্তি করলেও স্পেশ্যাল এডুকেটর রাখছে না। প্রতিবন্ধীর সরকারি কার্ডকে গুরুত্ব না দিয়ে হেনস্থা করেছেন বাস কন্ডাক্টর। কোথাও চাকরিতে সফল হয়েও বিনা কারণে তাঁকে বাতিল করা হয়েছে। প্রতিবন্ধী কমিশনার মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় অসহায় মুখে বলছিলেন, ‘কত সমস্যা সমাধান করব? এত লোকজন, পরিকাঠামো কোথায় আমাদের? আইন দিয়ে সব কিছু হয় না। মনের ভিতর থেকে, সমাজের অন্দর থেকে মানসিকতা বদলাতে হবে। কবে তা হবে, জানি না।’
এখনও মাধ্যমিক স্তরের পরে ব্রেল-এ লেখা বই পেতে দৃষ্টিহীনদের হাতড়ে বেড়াতে হয়। মাধ্যমিক পর্বেও রেফারেন্স বই খুঁজতে গেলে মেলে না। বই ছাপা হয় না মাসের পর মাস। উচ্চ শিক্ষায় ভরসা বলতে স্যরদের লেকচার টেপ করা, নয়তো সহপাঠীদের দয়া করে পাঠ্যবই রিডিং পড়িয়ে নেওয়া। পরীক্ষার সময় রাইটার পেতে কালঘাম ছুটে যায়।
মানসিক বা শারীরিক প্রতিবন্ধী সন্তান হলেই এ দেশে বাবা-মায়ের প্রধান চিন্তা হয়, ‘আমরা যখন থাকব না তখন ওকে কে দেখবে।’ চিন্তা হয়, কারণ আমাদের দেশের সরকার এঁদের যত্ন থেকে হাত গুটিয়ে থাকে। টাকা দিলেও এমন পুনর্বাসন কেন্দ্র পাওয়া দুর্লভ যেখানে আমৃত্যু কোনও অভিভাবকহীন বা আত্মীয়হীন প্রতিবন্ধীর দেখভাল করা হবে।
হংকং, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্সের মতো পুঁচকে-পুঁচকে দেশে ভাল হোক-মন্দ হোক প্রতিবন্ধীদের জন্য একটা আইন রয়েছে বহু দিন আগে থেকে। আইন থাকা মানে অন্তত মানুষগুলো যে রয়েছেন, সেটা স্বীকার করা। আর ভারতের মতো ১০০ কোটি জনসংখ্যার দেশে সেই অস্তিত্বটাই মেনে নেওয়া হল এই সে দিন, ১৯৯৫ সালে আইন করে। তাতে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোর লাভ হল বটে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার-টধিকার নিয়ে গলা ফাটিয়ে বিদেশি টাকা জোগাড় হল। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের অবস্থা কতটা শুধরোল? একটা কথা চালু রয়েছে এই মানুষগুলোকে নিয়ে। ‘ইনভিজিব্ল মাইনরিটি’, অদৃশ্য সংখ্যালঘু। বোঝা গেল না? ছোট্ট একটা হিসাব দেওয়া যাক। আমেরিকা বা ইউরোপের দেশগুলোয় (যেখানে এমনিই জনসংখ্যা কম) জনসংখ্যার ৭-৮% প্রতিবন্ধী। সেখানে সরকারি জনগণনা রিপোর্ট বলছে, ভারতের মতো বিশাল দেশে নাকি জনসংখ্যার মাত্র ২% প্রতিবন্ধী!
তা হলে কি ঈশ্বরের আশীর্বাদে ভারতের জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিবন্ধকতা কম? ধুর, ধুর। ভারতের ‘ন্যাশনাল সেন্টার ফর প্রোমোশন অব এমপ্লয়মেন্ট ফর ডিসেব্লড পিপ্ল’ এর ডিরেক্টর জাভেদ আবিদি (যিনি নিজেও শারীরিক প্রতিবন্ধী) ‘স্প্যাস্টিক্স সোসাইটি অব ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’-র জার্নাল ‘দীপশিখা’-য় লিখেছিলেন, ‘এটা হল সরকারের সহজ সমীকরণ। প্রতিবন্ধীদের প্রকৃত সংখ্যাটা দেখিও না। স্রেফ ‘অদৃশ্য’ করে দাও। তা হলে তাঁদের জন্য সরকারি সুযোগ-সুবিধা, নীতি নির্ধারণের ঝক্কিও কম হবে। পরিকাঠামো গড়ার হ্যাপাও থাকবে না। ভারতে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রতিবন্ধীদের জন্য ২৩টি বিশেষ এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ তৈরি হয়েছে (প্রথমটি হয়েছিল ১৯৫৯-এ), সাধারণ এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে এঁদের জন্য ৫৫টি নতুন সেল হয়েছে। কিন্তু ফল? গত ৪০ বছরে এখান থেকে চাকরি পেয়েছেন সাকুল্যে মাত্র ১ লাখ প্রতিবন্ধী।’
আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়ায় প্রতিবন্ধীদের যাতায়াতের আলাদা যানবাহন, সরকারি ও বেসরকারি ভবনে তাঁদের ঢোকা-বেরনোর আলাদা ব্যবস্থা, পার্কিংয়ের বন্দোবস্ত, শৌচাগারের ব্যবস্থা, বসার উপযুক্ত চেয়ার-টেবিল, আগুন লাগলে তাঁদের জন্য উপযুক্ত ইমার্জেন্সি এগ্জিট-এর মতো বিভিন্ন সুবিধা রাখা বাধ্যতামূলক। আর আমাদের দেশে পাবলিক বাসের পাদানিটুকু একটু নিচে করার কথাও এত দিনে কারও মনে হয় না।
এই সব শুনে জিজা হাসছিলেন। জিজা ঘোষ। সেরিব্রাল পল্সি আক্রান্ত। অসুখের জন্য হাঁটাচলা, কথাবলায় অসুবিধা তাঁর। তাও দাপটে পড়াশোনা করেছেন, বিয়ে করে সংসার করছেন, তারাতলায় ‘ইনস্টিটিউট অফ সেরিব্রাল পল্সি’তে চাকরি করছেন। তাঁকেই মানসিক ভারসাম্যহীন মনে করে গোয়াগামী বেসরকারি বিমান থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল, গত বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি। অপমানিত, স্তম্ভিত জিজা শেষ দেখে ছেড়েছিলেন। আদালতের নির্দেশে ক্ষমা চেয়েছিল বিমান সংস্থা। কিন্তু জিজা বলছেন, ‘কী লাভ? অধিকাংশ মানুষ এখনও সেরিব্রাল পল্সি, মানসিক ভারসাম্যহীনতা, অটিজ্ম, ডিস্লেক্সিয়া এগুলোর পার্থক্য সম্পর্কে বিলকুল অজ্ঞ। তাদের কাছে, এঁরা সবাই এক কথায় ‘পাগল’। হয় এঁদের পাগলা-গারদে থাকা উচিত, নয়তো বাড়িতে দরজা বন্ধ করে রাখা দরকার। মানুষেরও দোষ নেই। প্রশাসন প্রতিবন্ধীদের জন্য চাকরি রাখবে না, প্রতিবন্ধীদের সাধারণ স্কুলে পড়াশোনা করতে দেবে না, তা হলে তো সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতিবন্ধীরা কোনও দিন মিশতে পারবেন না। দূরত্ব থেকেই যাবে।’
জিজা বলেন, ‘কেউ আমাদের অবজ্ঞা করে, হ্যারাস করে। আবার কেউ আমাদের সঙ্গে কী ভাবে কথা বলবে, মিশবে বুঝেই পায় না। বাচ্চাদের মতো ট্রিট করে, কখনও অসম্ভব দয়া, করুণা দেখায়। কিছুতেই আর পাঁচটা স্বাভাবিক মানুষের মতো ভাবতে পারে না।’
জিজার সহকর্মী শাশ্বতী এক দিনের জন্য একটা ‘খেলা’ খেলার অনুরোধ করেছিলেন।
কী খেলা?
২৪ ঘণ্টা প্রশাসনিক কর্তা বা সরকারের মাথাদের যদি চোখ বেঁধে রাখা যায়, কিম্বা পা বেঁধে হুইলচেয়ারে বসিয়ে রাখা যায়? বা ধরা যাক এমন ব্যবস্থা করা হল যে তাঁদের কানে পৃথিবীর কোনও আওয়াজ যাবে না? একমাত্র তখন বোধহয় তাঁদের বোধ আসবে, প্রাত্যহিক দিনযাপনে ঠিক কোন কোন জিনিস এক জন প্রতিবন্ধীর দরকার। শাশ্বতী মানে শাশ্বতী আচার্য মহন্তি। সেরিব্রাল পল্সি আক্রান্ত। প্রতিবন্ধকতা নিয়েই চাকরি এবং সংসার একসঙ্গে সামলান। ১২ বছরের সুস্থ-সবল মেয়ে রয়েছে তাঁর। স্বাভাবিক জীবনযাপনের চেষ্টায় অনবরত ঠোক্কর খেতে হয় তাঁকে। শাশ্বতীর কথায়, ‘বাসে উঠলে প্রতিবন্ধীদের ধরে দাঁড়ানোর নিচুু রড নেই, মেট্রো রেলের অধিকাংশ স্টেশন লিফ্টহীন, বেশির ভাগ খেলার মাঠ-বাজার-সিনেমা হলে হুইলচেয়ার চালানোর র্যাম্প নেই। এটিএম কাউন্টারে টাকা তুলতে যেতে পারি না। কারণ, এমন উচ্চতায় মেশিন রাখা যে চেয়ারে বসে হাত যায় না। স্বামী-সন্তানের সঙ্গে ট্রেনে চড়ে বেড়াতে যাব, কিন্তু ট্রেনে উঠব কী করে? চারটে লোক লাগে কোলে করে ওঠানো-নামানোর জন্য। মেয়ের সঙ্গে কফি শপে খেতে গেলাম। ওঠার মুখে র্যাম্প নেই। চার হাত-পায়ে বেয়ে বেয়ে সকলের সামনে উঠলাম। এটাকে কি আত্মসম্মান নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন বলে?’
প্রতিবন্ধীদের আত্মসম্মানের কে আর কবে পরোয়া করে? বর্ধমানের স্কুলে সেরিব্রাল পল্সি-আক্রান্ত মাস্টারমশাইকে তাই পাগল বলে বেধড়ক পেটানো যায়। মূক-বধিরেরা ধর্ষণের ‘সফ্ট টার্গেট’ হন কারণ, তাঁদের অভিযোগ জানানোর সম্ভাবনা কম। দিনশেষে প্রশাসনের হাতে পড়ে থাকে দামোদরের চর থেকে খুঁড়ে বার করা প্রতিবন্ধীর হাড়গোড়। |
|
|
|
|
|