অন্য রাজ্য থেকে হোক বা বাংলাদেশ-মায়ানমার, আমদানিতে বেজায় খরচ। তাই বাঙালির পাতে ইলিশ জোগাতে কৃত্রিম প্রজননের পথে হাঁটছে রাজ্য সরকার। তার জন্য গড়ে তোলা হবে গবেষণা কেন্দ্র। বাড়ানো হবে ইলিশের উৎপাদন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই মঙ্গলবার মহাকরণে এ কথা জানান। তাঁর কথায়, “প্রতি বছর বাইরে থেকে ইলিশ আমদানি করতে হয়। এতে খরচও পড়ে বেশি। এখানেই উৎপাদন করলে খরচ কমবে।”
বাঙালির অন্যতম প্রিয় মাছ ইলিশ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্বেগ ও উদ্যোগ সঙ্গত বলেই মনে করেন গবেষকেরা। তাঁরা জানান, কয়েক বছর আগেও হুগলি নদীতে প্রচুর ইলিশ মিলত। কিন্তু এখন তা প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১০-’১১ সালে রাজ্যে ইলিশ উৎপাদন হয়েছিল ৬০ হাজার টন। ২০১১-’১২ সালে তা কমে হয় ২০ হাজার টন। আর গত অর্থবছরে মিলেছে মাত্র আট হাজার টন ইলিশ। অথচ প্রতি বছর রাজ্যের ন্যূনতম চাহিদা প্রায় ১৫ হাজার টন। চাহিদা মেটাতে অগত্যা বাংলাদেশ, মায়ানমার অথবা গুজরাতের উপরে ভরসা করতে হয় পশ্চিমবঙ্গকে। এই অবস্থায় বাঙালি রসনায় ইলিশ জোগাতে মুখ্যমন্ত্রীর গবেষণা কেন্দ্র গড়ার পরিকল্পনা খুবই সঙ্গত ও স্বাভাবিক, বলছেন বিশেষজ্ঞেরা।
কিন্তু ইলিশের উৎপাদন এতটা কমে যাওয়ার কারণ কী?
ইলিশ-বিশেষজ্ঞেরা এর পিছনে মূলত দু’টি কারণ দেখছেন।
i হুগলি নদীতে গভীরতা কমেছে। সাগরে মোহনার মুখ পলি জমে প্রায় বন্ধ হয়েছে। সমুদ্র থেকে নদীতে আসার জন্য মোহনার মুখে জলের প্রয়োজনীয় গভীরতা না-পেয়ে ঝাঁক ঝাঁক ইলিশ পথ পরিবর্তন করে ইরাবতী ও মেঘনার দিকে চলে যাচ্ছে।
i সাগরে, মোহনার মুখে ঢোকার আগেই ছোট ফাঁসের জাল ফেলে ইলিশ ধরে নিচ্ছেন মৎস্যজীবীরা। কিছু কিছু ইলিশ নদীতে ঢুকছে ঠিকই। কিন্তু ডিম থেকে বাচ্চা হওয়ার পরেই কয়েক ইঞ্চি লম্বা ইলিশ চলে যাচ্ছে ধীবরদের হেফাজতে।
বিশেষজ্ঞেরা জানান, সমুদ্র থেকে মিষ্টি জলের আশায় ইলিশের নদীতে ঢোকা আবার নদী থেকে ইলিশের সমুদ্রে যাওয়া একটা জীবনচক্র। ডিম থেকে মিষ্টি জলে যাতে বাচ্চা হয়, সেই জন্যই নদীতে আসে ইলিশ। নদীতে মাস পাঁচেক কাটিয়ে বাচ্চা একটু বড় হলেই ফের তারা চলে যায় সমুদ্রের গর্ভে। সেখানে পূর্ণ চেহারার ইলিশ পেটে ডিম নিয়ে ফের চলে আসে নদীতে, বাচ্চার জন্ম দিতে। এই আসা-যাওয়ার পথে অকালে বাধা পাওয়ায় বা ধরা পড়ে যাওয়ায় চক্র সম্পূর্ণ হওয়ার সময় পাচ্ছে না। পরিণামে ইলিশ যাচ্ছে কমে। ইলিশের কৃত্রিম প্রজনন সফল হলে উৎপাদনের ঘাটতি সামাল দেওয়া যাবে।
গবেষণা কেন্দ্রে কী কী কাজ হবে?
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষিত গবেষণা কেন্দ্রে ইলিশ সংরক্ষণের বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে চর্চা হবে। কোন কোন পথ অবলম্বন করলে রাজ্যে ইলিশের উৎপাদন বাড়তে পারে, সরকারকে তার পথ বাতলাবেন গবেষকেরা। কেন্দ্রীয় অন্তর্দেশীয় মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের নদী-মৎস্য বিভাগের সদ্য-প্রাক্তন প্রধান উৎপল ভৌমিক জানান, কৃত্রিম উপায়ে প্রজনন ঘটিয়ে ইলিশের উৎপাদন বাড়ানোই হবে গবেষণা কেন্দ্রের লক্ষ্য। গবেষণা কেন্দ্রে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে বাচ্চার জন্ম দিয়ে তা ওই কেন্দ্রের পুকুরেই ছাড়া হবে। একটু বড় হলে সেই ইলিশ পাঠিয়ে দেওয়া হবে নদীতে। উৎপাদন বাড়াতে জালের ফাঁস বড় করা, ছোট ইলিশ ধরা বন্ধ করার মতো জানা বিষয়গুলি তো থাকবেই। তবে গবেষণা কেন্দ্র কোথায় হবে, তা এখনও ঠিক হয়নি।
কিন্তু গবেষণা কেন্দ্রে কি ইলিশের বীজ বপন সম্ভব? সেটা যদি সম্ভবও হয়, ইলিশের সেই স্বাদ মিলবে কি?
উৎপলবাবুর কথায়, “এই নিয়ে রাজ্যে এবং বাংলাদেশে অনেক দিন ধরে গবেষণা চলছে। আরও একটু সময় লাগলেও তা সম্ভব।”
নজর শুধু ইলিশেই নয়। বড় মাছের আকাল মেটাতেও উদ্যোগী হচ্ছে রাজ্য। মুখ্যমন্ত্রী জানান, রায়পুর, হায়দরাবাদ থেকে বড় মাছ আসছে। এখানে ওই মাপের মাছ উৎপাদন হচ্ছে না। কারণ রাজ্যে বড় জলাধারের অভাব। “এই অভাব দূর করে বড় মাছের উৎপাদন বাড়াতে রাজ্যে বড় জলাধার ব্যবস্থা করব। কয়েকটি জায়গা দেখা হয়েছে,” আশ্বাস মমতার।
|