কয়েক বছর আগেও তাঁকে দেখে ঘেন্নায় থুতু ফেলে সরে যেতেন গ্রামের মানুষ। ছোঁওয়া লাগলে তড়িঘড়ি স্নান করতেন। তাঁর দুই মেয়েকে বার করে দেওয়া হয়েছিল স্কুল থেকে। স্বামীর মৃত্যুর পর পোড়াবার লোক পর্যন্ত পাননি। নিজেই মাটি খুঁড়ে দেহ পুঁতে দেন। কারণ, তিনি যে এইচআইভি আক্রান্ত!
সেই মহিলাই এখন মঞ্চে উঠে গাইছেন। গাইছেন নিজের জীবন নিয়ে লেখা গান। গলা মেলাচ্ছেন বাউলদের সঙ্গে। এইচআইভি সচেতনতা প্রকল্পে তাঁকে সঙ্গে নিয়েই চলছে প্রচার। বাউলেরা তাঁর জীবন নিয়ে লেখা গান গেয়েছেন এক-একটি গ্রামের মঞ্চে, টানা তিন-চার রাত ধরে। বিশ্বব্যাঙ্ক ও ‘ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসাচর্’ (আইসিএমআর)-এর অর্থসাহায্যে পশ্চিম মেদিনীপুরের কেলেগোদা ও রানিচক এবং হাওড়ার কালিনগর ও মাজু গ্রামে এই সচেতনতা প্রকল্প চলেছে দু’ বছর। তাতে যে ফল মিলেছে, তা দেখে অবাক প্রকল্পকর্তারাও।
প্রকল্পের মূল উপদেষ্টা ‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ কলেরা অ্যান্ড এনটেরিক ডিজিজেস’ (নাইসেড)-এর ডেপুটি ডিরেক্টর সমীরণ পণ্ডা জানান, প্রকল্প শেষে ওই চারটি গ্রামে সরকারি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, সেখানে এইচআইভি নিয়ে ধারণা, এইচআইভি আক্রান্তদের প্রতি নেতিবাচক মনোভাব ৯৮ শতাংশ বদলে গিয়েছে। সমীরণবাবুর কথায়, “আড়াল থেকে বেরিয়ে এইচআইভি-আক্রান্ত একজন গ্রামের বউ নিজে মঞ্চে থাকছেন, তাঁর জীবনের কাহিনি নিয়ে বাউলেরা গান গাইছেন, ব্যাপারটা এতটাই অভিনব যে গ্রামের মানুষকে তা ছুঁয়ে গিয়েছে। তাঁরা এইচআইভি নিয়ে ভুল ধারণা অনেকটাই কাটাতে পেরেছেন।” |
এ বার এই মডেল অনুসরণ করেই রাজ্যে এইচআইভি সচেতনতা ও প্রচার কর্মসূচিতে পরিবর্তন আনার পরিকল্পনা নিচ্ছে রাজ্য এডস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কমিটি বা ‘স্যাক্স।’ সাক্সের উপ-অধিকর্তা হিমাদ্রি সান্যালের কথায়, “কোনও এক জন এইচআইভি আক্রান্তকে মডেল করে তাঁর জীবন নিয়ে বাউলেরা মঞ্চে গান গাইছেনএই ব্যাপারটাই নতুন। আক্রান্ত নিজে মঞ্চে উপস্থিত থেকে নিজের কথা বলছেন, অন্যদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন, এই ব্যাপারটাতেও সাধারণ মানুষ সাড়া দিয়েছেন। তাই এই মডেলেই কাজ করার কথা প্রাথমিক ভাবে ভাবা হচ্ছে।”
এ ব্যাপারে কী বলছেন দোহারা চেহারা, শ্যামলা গায়ের রঙ, সাদামাঠা তাঁতের শাড়ি পরা বছর তিরিশের গৃহবধূটি? তাঁর বক্তব্য, “সবাই অচ্ছুত করে দিয়েছিলেন। জেদ চেপে গেল আমার, এইচআইভি নিয়ে লোকের ভ্রান্ত ধারণা ভাঙবই। স্বপ্ন দেখতাম, এক দিন এইচআইভি আক্রান্তদের সমাজ সম্মান দিয়ে গ্রহণ করবেই।
সেই চাওয়া থেকেই বাউলদের
নিজের জীবনের গান গাওয়ার ব্যাপারে সম্মতি জানিয়েছিলাম।”
বাউল গানের অনুষ্ঠানের পর গ্রাম কী ভাবে বদলে গিয়েছে তার গল্প শোনাচ্ছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের রানিচকের পঞ্চায়েত প্রধান নিরঞ্জন পাল। গ্রামের এক বাড়িতে দুই ভাই এইচআইভি আক্রান্ত ছিলেন। তাঁদের একঘরে করা হয়েছিল। ওই বধূর জীবন নিয়ে বাঁধা বাউল গান শুনে গ্রামের লোক তাঁদের বাড়ি গিয়ে ক্ষমা চেয়ে এসেছেন। হাওড়ার কালীনগর গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান সাবির মল্লিক জানান, তাঁদের গ্রামের এক জন এইচআইভি আক্রান্তের মেয়েকে টিকা দিয়ে রাজি হচ্ছিলেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা। ওই গৃহবধূর অনুষ্ঠানের পর তাঁরা নিজেদের ভুল মেনে শুধরে নিয়েছেন।
গৃহবধূর সঙ্গে গান গাওয়ার লোক খুঁজে পেতে কিন্তু নাজেহাল হতে হয়েছিল আইসিএমআরকে। প্রকল্পের এক কর্তা জানান, কোনও বাউল দলই এইচআইভি আক্রান্তের সঙ্গে অনুষ্ঠান করতে চাইছিল না। তাতে নাকি রোগ হয়ে যাবে। অনেক খুঁজে এই দলটিকে রাজি করানো হয়। ওই দলের প্রধান গাইয়ে প্রভাত বাউল বলছিলেন, “ভয় আমাদেরও ছিল। কয়েকটা অনুষ্ঠানের পর সবাই সুস্থ আছি কি না দেখতে রক্তপরীক্ষাও করিয়েছিলাম।”
এখনও কি সেই ধারণা রয়েছে?
লজ্জা পেয়ে হেসে ওই বধূকে পাশে বসিয়ে গান ধরেন প্রভাত “রক্তের মধ্যে কী আছে দাদা
কেউ তা জানে না
বাইরে থেকে দেখেও তাঁদের বোঝা যায় না
তাই, আগে নয় কোষ্ঠীবিচার, তুলসী মিলন, করুন রক্তপরীক্ষা
এ কথা আমি নয়, বলছে নানা সমীক্ষা.....।”
এই গৃহবধূর জীবনের সঙ্গে বিহারের গয়া জেলার প্রত্যন্ত গ্রামের এইচআইভি পজিটিভ এক মহিলার জীবনের মিল খুঁজে পাচ্ছেন স্যাক্সের কর্তারা। স্বামীর থেকে আক্রান্ত ওই মহিলাও সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, রোগের কথা গোপন করবেন না। সব কিছু জেনে একঘরে করার বদলে সাদরে তাঁকে গ্রহণ করেছিলেন গ্রামের সকলে। বিহারের স্যাক্সের প্রচারপুস্তিকায় ছাপা হয়েছিল তাঁর ছবি। টিভি-রেডিওয় প্রচার চালানো হয়েছিল তাঁর জীবন নিয়ে। পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রার্থীও হয়েছিলেন তিনি। তাঁর লড়াইকে সম্মান জানিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে দাঁড়াননি অন্য কোনও প্রার্থী।
রাজ্যের এই লড়াকু মহিলাও একই রকম সামাজিক সম্মান পাওয়ার যোগ্য বলে মনে করছেন স্যাক্সের কর্তারা। |