বাগিচায় আর মালি নেই।
শুকনো পাতার স্তূপের আড়ালে পড়ে রয়েছে অনাদৃত উদ্যান। সাজানো জলাশয় ভরে উঠেছে দল-শ্যাওলায়। বন দফতরের অধীনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন পার্ক কিংবা উদ্যানগুলি সরকারি নির্দেশের গুঁতোয় আপাতত এমনই আগাছা-দীর্ণ, অভিভাবকহীন।
চলতি আর্থিক বছরের গোড়ায়, বন দফতর তাদের উদ্যান ও কানন শাখার অস্তিত্বই কার্যত তুলে দেওয়ায় উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের অন্তত ২৯টি সরকারি বাগানে নজরদারির রেওয়াজই উঠে গিয়েছে। উদ্বৃত্ত কর্মীর দোহাই দিয়ে আস্ত একটা শাখা ছেঁটে ফেলায় বন দফতরের ওই সাজানো বাগানগুলির ভবিষ্যৎই অস্পষ্ট হয়ে পড়েছে। অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বাগিচা পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা ওই বিভাগের অন্তত শ’পাঁচেক কর্মীর (গার্ডেন-ক্যাডার) কাজের ধরন।
শুধু উদ্যান নয়, রাজারহাট, হলদিয়া বা দুর্গাপুরের মতো পরিকল্পিত নগরীর সৌন্দর্যায়নের দায়িত্বে ছিল বন দফতরের ওই শাখা। কলকাতার বেশ কয়েকটি রাস্তা মরসুমি ফুল কিংবা গাছ-গাছালি দিয়ে সাজিয়ে তোলাও চলছিল উদ্যান ও কানন শাখার তত্ত্বাবধানে। ফলে মুখ্যমন্ত্রীর সাধের সেই সৌন্দর্যায়নই প্রশ্নের মুখে থমকে দাঁড়াল। এক শীর্ষ বন-কর্তা রাখঢাক না রেখেই বলছেন, “হঠকারি এই সরকারি সিদ্ধান্তের ঠেলায় মুখ্যমন্ত্রীর সাধের সৌন্দর্যায়নের উদ্যোগে কার্যত জল ঢেলে দেওয়া হয়েছে।”
শুধু বাগান পরিচর্যাই নয়, দুর্গাপুর শিল্পনগরী, মেজিয়া তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র, পাঞ্চেত, মাইথনের জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের উপনগরীর সৌন্দর্যায়ন এবং তা রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল উদ্যান ও কানন শাখার। বন দফতর সূত্রে খবর, বাহারি ফুলের চারা লাগানোই নয়, এ ধরনের বড় শিল্পক্ষেত্রে দূষণ রুখতেও বিশেষ ‘ল্যান্ডস্কেপ’ তৈরি এবং বনসৃজনও করত ওই শাখা। রাজ্যে নতুন শিল্পক্ষেত্র গড়ে উঠলে সে কাজ এ বার কে করবে, সে উত্তরও অনিশ্চিত।
বন দফতরের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে খোদ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছেই নালিশ ঠুকেছে শাসক দলের কর্মচারী সংগঠন, ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট সার্ভিস এমপ্লয়িজ ফেডারেশন’। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অমল সিংহ বলেন, “এর ফলে, মুখ্যমন্ত্রীর সৌন্দর্যায়নের পরিকল্পনাই বানচাল হয়ে যাবে। তা ছাড়া, বাগান সাজানো তো নিছক সৌন্দর্যায়ন নয়, তার সঙ্গে পরিবেশ-সুরক্ষার প্রশ্নও জড়িত।” একমত বন দফতরের বাম সংগঠন, ‘সাবর্ডিনেট ফরেস্ট সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন’ও। সংগঠনের সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দেবীদাস সরকার বলেন, “যাঁরা এত দিন বাগান পরিচর্যা করলেন, তাঁদের হাতি ঠেকানোর কাজ দিলে পারবেন কেন!” অবশ্য বনমন্ত্রী হিতেন বর্মনের মতে, “সৌন্দর্যায়নের সঙ্গে হাতি ঠেকানোর বিরোধ নেই। না পারার কী আছে!”
কলকাতার ইডেন গার্ডেন কিংবা সল্টলেকের বনবিতান এখনও ‘অভিভাবকহীন’ নয়। কিন্তু তা যে সময়ের অপেক্ষা বনমন্ত্রীর কথাতেই তা স্পষ্ট। তিনি জানান, দক্ষিণ কলকাতার রেঞ্জটিও গোটানোর চেষ্টা হচ্ছে। সেখাকার কর্মীদেরও কি অন্যত্র সরিয়ে দেওয়া হবে? হিতেনবাবুর কথায় তারই সায় মিলেছে।
বন বিশেষজ্ঞদের অধিকাংশেরই দাবি, বাগান পরিচর্যার দায়িত্বে থাকা কর্মীরা ‘স্পেশ্যালাইজড’ কাজ জানেন। কোথায়, কোন মাটিতে, কী গাছের চারা লাগানো হবে, কী ধরনের সার দেওয়া প্রয়োজন, কোন মরসুমে কী ফুলের চারা লাগানো হবেএই ধরনের কাজেই তাঁরা বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষিত। বন পাহারা বা হাতি ‘খেদানোর’ কাজ তাঁরা তেমন দড় হবেন না। সে যুক্তি শুনছে কে?
১ এপ্রিল আচমকাই বিজ্ঞপ্তি (৬৬৭/৬৬৮ এফওআর-১.৪.২০১৩) জারি করে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের অধিকাংশ জেলা থেকে উদ্যান ও কানন বিভাগের অস্তিত্ব মুছে দেওয়া হয়েছে। কর্মীদের যোগ দিতে বলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলা ডিভিশনে।
কিন্তু বন দফতরেরই একটি সূত্র বলছে, নতুন দফতরে বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়-দায়িত্ব, বন-পাহারা কিংবা গাছ কাটার মতো হ্যাপা সামলে বাগান পরিচর্যার জন্য সময় বার করা প্রায় দুঃসাধ্য। গত দেড় মাস ধরে বাগানগুলিতে তাই জমেছে শুকনো পাতার স্তূপ। যার আড়ালে বিভিন্ন মরসুমি ফুলের চারা ‘বাল্যেই’ হারিয়ে গিয়েছে। আগাছার ভিড়ে মুখ লুকিয়েছে সাজানো কেয়ারি। জলাশয় গিয়েছে শ্যাওলার দখলে।
বাগিচায় যে আর মালি নেই! |