ভোটে লড়ে রাজনৈতিক দল। জয়-পরাজয়ের নিষ্পত্তিও হয় তাদের মধ্যেই। মাঝে রেফারির ভূমিকায় নির্বাচন কমিশন। এর মধ্যে সরকার আসবে কেন? রাজ্য নির্বাচন কমিশনের তোলা সেই প্রশ্নের কোনও নিষ্পত্তি কিন্তু করল না কলকাতা হাইকোর্ট। রাজ্য পঞ্চায়েত আইন নিয়ে কোনও মন্তব্যই করেনি বিচারপতি বিশ্বনাথ সমাদ্দারের সিঙ্গল বেঞ্চ কিংবা প্রধান বিচারপতি অরুণকুমার মিশ্রের ডিভিশন বেঞ্চ।
রাজ্য সরকার ২০০৩ সালের রাজ্য পঞ্চায়েত আইনের ৪২ ধারা অনুযায়ী পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণা করেছিল। রাজ্য নির্বাচন কমিশনের অভিযোগ ছিল রাজ্য সরকার একতরফা ভাবে নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা করেছে। পঞ্চায়েত আইনের ৪২ ধারা না থাকলে এই ধরনের কোনও সমস্যাই হত না বলে মনে করে কমিশন। বস্তুতপক্ষে পশ্চিমবঙ্গ, কেরল এবং মণিপুরের মতো হাতেগোনা কয়েকটি রাজ্য ছাড়া আর কোথাওই এখন পর্যন্ত পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিন ঘোষণার অধিকার রাজ্যের হাতে নেই।
নির্বাচন কমিশন হাইকোর্টে যে মামলা করেছিল তার অন্যতম আর্জি ছিল, ওই ৪২ নম্বর ধারা বাতিল করা হোক। যুক্তি হিসেবে তারা সংবিধানের ২৪৩ ধারাকে হাতিয়ার করেছিল। বলা হয়েছিল, ওই ধারার সব উপধারাতেই ভোট পরিচালনার যাবতীয় কর্তৃত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত। সংবিধানের সেই ধারাকে মান্যতা দিয়েই আইন প্রণয়ন করার কথা রাজ্যের। কমিশনের আইনজীবী সমরাদিত্য পাল সুপ্রিম কোর্টের একাধিক রায় তুলে ধরে আদালতে দাবি করেছিলেন রাজ্যের পঞ্চায়েত আইনের ৪২ ধারাটি অসাংবিধানিক।
কিন্তু হাইকোর্ট ৪২ ধারা সম্পর্কে পুরো নীরব থাকায় কমিশন কিছুটা বিভ্রান্ত। তাঁরা ওই বিষয়টি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করবে, নাকি ফের বিচারপতি সমাদ্দারের বেঞ্চে গিয়ে ব্যাখ্যা চাইবে, তা ঠিক করে উঠতে পারেনি তারা। কমিশনের সচিব তাপস রায় এ দিন বলেন, “৪২ ধারা নিয়ে সিঙ্গল বেঞ্চ বা ডিভিশন বেঞ্চ স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। তাই বিষয়টি ঠিক কী অবস্থায় রয়েছে, তা নিয়েও আইনজীবীর সঙ্গে আলোচনা হবে।” তবে হাইকোর্ট সূত্রে বলা হচ্ছে, এ দিন ডিভিশন বেঞ্চের কাছে কমিশনের পক্ষ থেকে বিষয়টি উত্থাপন করা হয়েছিল। ডিভিশন বেঞ্চ সিঙ্গল বেঞ্চের কাছেই বিষয়টি সওয়াল করতে বলেছে।
মুম্বই হাইকোর্টের প্রাক্তন প্রধান বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলছেন, “৪২ ধারা বাতিল করা নিয়ে কমিশনকে আলাদা ভাবে মামলা করতে হবে।” তাঁর মতে, “ডিভিশন বেঞ্চ যেটা করেছে, তা উভয় পক্ষের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধানসূত্র। এখানে আইনের বিচার হয়নি। আবার উভয় পক্ষের মতামত নিয়ে যদি এই নির্দেশ দেওয়া হয়ে থাকে, তা হলে আপিল মামলা করা যাবে না। সিঙ্গল বেঞ্চের রায়টিও ভবিষ্যতে নজির হিসেবে গণ্য করা যাবে না।” অর্থাৎ, ৪২-এর জট ছাড়াতে আলাদা মামলা ছাড়া গতি নেই।
পঞ্চায়েত আইনের ধারা নিয়ে যে প্রশ্ন উঠেছিল সে সম্পর্কে ডিভিশন বেঞ্চ মন্তব্য করল না কেন, এই প্রশ্নের জবাবে কলকাতা হাইকোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি ভগবতীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “পঞ্চায়েত মামলা নিয়ে ডিভিশন বেঞ্চ সে ভাবে কোনও রায় দেয়নি। কমিশন এবং রাজ্যের মধ্যে একটা মধ্যস্থতা করে দিয়েছে। যাতে পঞ্চায়েত নির্বাচনটা করা যায়। গুরুত্বপূর্ণ মামলার ক্ষেত্রে এখন এই ধরনের পথ অনেক সময় বেছে নেওয়া হচ্ছে।”
৪২ ধারা নিয়ে সিঙ্গল বেঞ্চে যাওয়া হবে, না সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে, তা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের অন্দরেই দু’টি মত। কমিশনের একটি সূত্রের বক্তব্য, “ডিভিশন বেঞ্চের নির্দেশে পঞ্চায়েত আইনের ৪২ নম্বর ধারা অনুযায়ী রাজ্য সরকারকেই নির্বাচনের দিন ঘোষণা করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সিঙ্গল বেঞ্চ কিন্তু কমিশনকেই দিন ঘোষণার দায়িত্ব দিয়েছিল। সে দিক দিয়ে সিঙ্গল বেঞ্চের রায়ই আমাদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য।” ফলে ফের সিঙ্গল বেঞ্চে গিয়ে এ ব্যাপারে সুফল পাওয়া যেতে পারে বলে মনে করছে কমিশনের এই সূত্রটি।
কিন্তু কমিশনের অন্য একটি সূত্রের মতে, সুপ্রিম কোর্টে গেলেই কমিশনের লাভ। কারণ সুপ্রিম কোর্ট চারটি বিভিন্ন মামলার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে সুনির্দিষ্ট রায় রয়েছে। ২০০৬ সালে কৃষ্ণ সিংহ তোমর বনাম আমদাবাদ পুরসভা মামলায় সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের ডিভিশন বেঞ্চ জানিয়ে দিয়েছিল, পঞ্চায়েত ও পুর নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মর্যাদা জাতীয় নির্বাচন কমিশনের মতোই।
ওই রায়ে বলা হয়, সংবিধানের ৩২৪ অনুচ্ছেদে জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, ২৪৩কে এবং ২৪৩জেডএ(১) অনুচ্ছেদে রাজ্য নির্বাচন কমিশনকেও একই ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পঞ্চায়েত ও পুর ভোট পরিচালনা, ভোটার তালিকা তৈরি ও ভোটের প্রস্তুতির ক্ষেত্রে রাজ্য নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের আওতার সম্পূর্ণ বাইরে থেকে কাজ করবে। সংবিধানের ২৪৩কে(৩) অনুচ্ছেদেও রাজ্য নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতার কথা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। ওই ধারা অনুযায়ী, রাজ্য নির্বাচন কমিশনের উপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী সরবরাহ করতে হবে রাজ্যপালকে। নির্বাচন পরিচালনার ক্ষেত্রে কমিশনকে সব ধরনের সাহায্য করতে রাজ্য সরকার বাধ্য। অবাধ ও মুক্ত নির্বাচন করার ক্ষেত্রে যা যা প্রয়োজন, তা নিয়ে রাজ্য নির্বাচন কমিশনের মতকে গুরুত্ব দিতে হবে।
২০১৩ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে কর্নাটকের ২০৮টি পুরসভার নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু রাজ্য সরকার ২০১১ সালের জনগণনা মেনে ওয়ার্ড ভিত্তিক সংরক্ষণের তালিকা ঘোষণা করতে পারেনি। রাজ্য নির্বাচন কমিশনার ২০০৭ সালের সংরক্ষণের তালিকা মেনে ভোট করাতে চেয়েছিলেন। এ নিয়ে বিরোধ বাধে সরকারের সঙ্গে। মামলা গড়ায় সুপ্রিম কোর্টে। আদালত জানিয়ে দেয়, নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ভোট করতে হবে। কৃষ্ণ সিংহ তোমর মামলার উল্লেখ করে রায়ে বলা হয়, ভোট পরিচালনার ক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা সর্বোচ্চ।
কমিশনের সূত্রটির আরও বক্তব্য, ২০১৩ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি অন্ধ্রপ্রদেশের পঞ্চায়েত ভোট নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়েও রাজ্য নির্বাচনের সর্বোচ্চ ক্ষমতার কথা মেনে নেওয়া হয়েছে। সূত্রটি এ ব্যাপারে ১৯৯৭ সালের একটি মামলার রায়েরও উল্লেখ করছে। অন্ধ্রপ্রদেশ, পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন পঞ্চায়েত ও পুরসভা ভোট সময়ে না-হওয়ায় আদালতের দ্বারস্থ হয় নানা সংস্থা। ১৯৯৭ সালের ১২ আগস্ট সুপ্রিম কোর্ট ওই মামলার রায়ে বলে, সংবিধানের ২৪৩ অনুচ্ছেদের প্রতিটি ধারা, উপধারা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলার ব্যাপারে জোর দিতে হবে। ভয়াবহ প্রাকৃতিক বিপর্যয় যেমন বন্যা, খরা, ভূমিকম্প ইত্যাদি অথবা কোনও জরুরি তথা শোচনীয় পরিস্থিতি ছাড়া কোনও রাজ্যই পঞ্চায়েত ভোট স্থগিত রাখতে পারবে না। |