প্রবন্ধ ২...
পশ্চিমবঙ্গ সব ব্যাপারেই মাঝারি, দারিদ্রেও
র আগে আমরা ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আর্থিক অসাম্যের কিছু পরিসংখ্যান নিয়ে আলোচনা করেছি। তা ছাড়া দারিদ্রের হিসাবনিকাশ নিয়েও আলোচনা করেছি। এই লেখায় বিভিন্ন রাজ্যে দারিদ্রের মাত্রা কী ভাবে পালটাচ্ছে, সেটা দেখার চেষ্টা করব। সঙ্গের সারণিতে দারিদ্র সীমার নীচে জনসংখ্যার (বি পি এল) অনুপাত দেখানো হয়েছে। প্রধান রাজ্যগুলির পরিসংখ্যানই দেওয়া হয়েছে এই তালিকায়। উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির হিসাব দেওয়া হয়নি প্রধানত এই কারণে যে, সেখানকার পরিসংখ্যান যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়। একমাত্র ত্রিপুরাকে হিসাবে রাখা হয়েছে, তার কারণ এই রাজ্যে উন্নয়ন ও দারিদ্র দূরীকরণের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালে লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়েছে বলে একটা ধারণা বেশ প্রচলিত।
দুটি বছরের হিসাব রয়েছে সারণিতে: ২০০৪-০৫ এবং ২০০৯-১০। আগেই বলেছি, জাতীয় নমুনা সমীক্ষার (এন এস এস) তথ্যের ভিত্তিতে তেন্ডুলকর কমিটির পদ্ধতি অনুসারে গ্রাম ও শহরের জন্য এবং সামগ্রিক ভাবে দারিদ্রের অনুপাত নির্ণয় করা হয়েছে। তালিকাটি এক নজর দেখলেই বোঝা যাচ্ছে, অসম, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওড়িশা এবং মধ্যপ্রদেশে দারিদ্রের মাত্রা খুবই বেশি। যে ষোলোটি রাজ্যের হিসাব এখানে দেওয়া হয়েছে তাদের মধ্যে, ২০০৯-১০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই পাঁচটি রাজ্যে দারিদ্রের অনুপাত সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে বেশি। বাকি এগারোটি রাজ্যে দারিদ্র সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে কম। এদের মধ্যে ওই গড়ের সবচেয়ে কাছে আছে পশ্চিমবঙ্গ। অর্থাত্‌, এই রাজ্যটি দারিদ্রের মাত্রায় সারা দেশের গড় অবস্থার কাছাকাছি। অন্য অনেক বিষয়েই এটা দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গ আক্ষরিক অর্থেই একটি মাঝারি মানের রাজ্য! অন্য দিকে, দারিদ্রের অনুপাত কুড়ি শতাংশের কম চারটি রাজ্যে কেরল, পঞ্জাব, তামিলনাড়ু ও ত্রিপুরা।
কয়েকটি রাজ্যে এই পাঁচ বছরে দারিদ্রের অনুপাত অনেকটা কমেছে। যেমন, অন্ধ্রপ্রদেশ, গুজরাত, কর্নাটক, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, তামিলনাড়ু এবং ত্রিপুরা। তাদের মধ্যে ত্রিপুরার অগ্রগতি, অন্তত এই পরিসংখ্যান অনুসারে, রীতিমত চমকপ্রদ। দুটি কারণে এই রাজ্যটি বিশেষ উল্লেখের দাবি রাখে। প্রথমত, পাঁচ বছরে দারিদ্রের অনুপাত, বিশেষত গ্রামাঞ্চলে, যতটা কমেছে, তা খুবই বিরল। দ্বিতীয়ত, ত্রিপুরা তো পঞ্জাব বা মহারাষ্ট্র নয়, এমনকী কেরলও নয়, অর্থনীতি এবং সমাজ, দু’দিক থেকেই রাজ্যটি বেশ অনগ্রসর। তাই এই কৃতিত্ব আরও বেশি চোখে পড়ে। অসম, বিহার, উত্তপ্রদেশের সঙ্গে তুলনা করলে ওড়িশার পরিসংখ্যান লক্ষণীয় এখনও দারিদ্র প্রবল, কিন্তু কমেছে অনেকটাই। বিশেষ করে ওড়িশার গ্রামীণ দারিদ্র লক্ষণীয় ভাবে কমেছে, যেটা সামগ্রিক দারিদ্রের পরিসংখ্যানেও উন্নতি ঘটিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও দারিদ্রের অনুপাত কমেছে, তবে যতটা কমা উচিত ছিল ততটা নয়। তামিলনাড়ুর গ্রামীণ দারিদ্র ২০০৪-০৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের কাছাকাছি ছিল, পাঁচ বছর পরে সেই রাজ্যে গ্রামীণ দারিদ্রের অনুপাত পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে অনেক কম। ত্রিপুরার তুলনায় তো পশ্চিমবঙ্গ নিতান্তই নিষ্প্রভ।
দারিদ্র কমে কেন? সামগ্রিক ভাবে বলা চলে, দ্রুত উন্নয়ন হলে সাধারণত দারিদ্র কমে, তার সঙ্গে বিশেষ দারিদ্র দূরীকরণ কর্মসূচিরও একটা ভূমিকা থাকতে পারে, যদি সেই কর্মসূচিগুলি ভাল ভাবে রূপায়িত হয়। কী ধরনের নীতি ও কর্মসূচি কার্যকর হতে পারে, আমরা সে বিষয়ে পরে আলোচনা করব। আপাতত একটা গোড়ার কথা বলে রাখা দরকার। ভারতে দারিদ্রের একটা বড় অংশ হল মূলত গ্রামীণ দারিদ্র। বিভিন্ন দরিদ্র-প্রধান রাজ্যের পরিসংখ্যানও সেই কথাই স্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিচ্ছে। সুতরাং কৃষির উন্নয়ন কেমন হচ্ছে, তার উপরে দারিদ্রের গতিপ্রকৃতি অনেকটা নির্ভর করে। যে রাজ্যগুলিতে, বিশেষত গ্রামে, দারিদ্রের অনুপাত বিশেষ কমেনি, সেগুলিতে কৃষির উপর নির্ভরশীলতা এখনও অনেক এবং কৃষির উন্নতিও সীমিত। এখানে বিহারের কথা আলাদা করে বলা দরকার। বিহারে সামগ্রিক অর্থনীতির এবং বিশেষত কৃষির অগ্রগতি সাম্প্রতিক কালে ত্বরান্বিত হয়েছে, কিন্তু এই তালিকায় তার বিশেষ ছাপ পড়েনি। হয়তো পরবর্তী সমীক্ষায় তার সুফল দেখা যেতে পরে। প্রসঙ্গত, ২০০৯-১০-এ দেশের একটা বড় অংশে কিছুটা খরা পরিস্থিতি ছিল, তার ফলে হয়তো কৃষির উন্নতি আরও কম হয়েছে, যার প্রতিফলন ঘটছে দারিদ্রের অনুপাতে।
রাজ্যবাসীর যত শতাংশ দারিদ্র সীমার নীচে
২০০৪-০৫ ২০০৯-১০

গ্রাম শহর মোট গ্রাম শহর মোট
কেরল
পঞ্জাব
তামিলনাড়ু
ত্রিপুরা
হরিয়ানা
অন্ধ্রপ্রদেশ
গুজরাত
কর্নাটক
মহারাষ্ট্র
রাজস্থান
পশ্চিমবঙ্গ
ভারত ৪২.০ ২৫.৫ ৩৭.২ ৩৩.৮ ২০.৯ ২৯.৮
মধ্যপ্রদেশ
ওড়িশা
উত্তরপ্রদেশ
অসম
বিহার
আর একটা কথা। দারিদ্রের অনুপাত যখন বেশি থাকে, তখন সেই অনুপাত কমানো যতটা সহজ, দারিদ্র কমে এলে সেই কাজটা তুলনায় কঠিন। মোটামুটি ভাবে বলা যায়, দারিদ্রের অনুপাত ১৫ শতাংশের নীচে নেমে এলে দারিদ্র আরও কমানো বেশ কঠিন হয়ে পড়ে, যে কারণে কেরলের মতো রাজ্যে দারিদ্রের অনুপাত কিছুটা ধীরে ধীরে কমছে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে সেটা এখনও বলা চলে না।
দারিদ্র দূর করার চেষ্টায় যত ঘাটতিই থাকুক, দারিদ্রের মাপজোখ নিয়ে উদ্যোগের বিরাম নেই। প্রথম ইউ পি এ সরকার অসংগঠিত এবং ইনফর্মাল সংস্থার জন্য একটি জাতীয় কমিশন নিয়োগ করেছিল, তারা দারিদ্রের একটি হিসাব কষেছিল। তাদের হিসাব অনুসারে ২০০৪-০৫ সালে ভারতে ৭৭ শতাংশ মানুষ ছিলেন বি পি এল গোষ্ঠীতে। এ ছাড়া আছে আন্তর্জাতিক হিসাব। আছে দু’রকম দারিদ্র রেখা: দৈনিক সওয়া এক ডলার আয় এবং দৈনিক দু’ডলার আয়। ২০০৫ সালের মূল্যমান অনুযায়ী এই অঙ্ক দুটি নেওয়া হয়েছে। এই হিসেবে ভারতে দরিদ্রের অনুপাত যথাক্রমে ৩৭ ও ৭৫.৬ শতাংশ।
দারিদ্র কেবল আয় বা ব্যয়ের ব্যাপার নয়। উন্নয়নও আয়ব্যয়ের চেয়ে বৃহত্তর বিষয়। এই কারণেই উদ্ভাবিত হয়েছিল সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (মিলেনিয়াম ডেভেলপমেন্ট গোল বা এম ডি জি)। তাতে ছিল বিভিন্ন লক্ষ্য ও সূচক। এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক হল প্রথম লক্ষ্য: চূড়ান্ত দারিদ্র এবং ক্ষুধার অবসান। এই উদ্দেশ্যে তিনটি করণীয় স্থির করা হয়:
(১) দিনে এক ডলারের কম আয় করেন এমন মানুষের অনুপাত ১৯৯০-এ যা ছিল, ২০১৫ সালে তার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে হবে;
(২) নারী ও অল্পবয়সী সহ সকলের জন্য যথাযথ কর্মসংস্থান করতে হবে;
(৩) ১৯৯০ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা অর্ধেক করতে হবে। প্রথম কাজটি দিয়ে বিচার করলে, ভারত খারাপ করছে না। বাকি দুটি নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে।
প্রতি বছর রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান (ইউ এন ডি পি) একটি মানব উন্নয়ন রিপোর্ট প্রকাশ করে। সাম্প্রতিক কালে এই বার্ষিক রিপোর্টে একটি বহুমাত্র প্রতি বছর রাষ্ট্রপুঞ্জের উন্নয়ন বিষয়ক প্রতিষ্ঠান (ইউ এন ডি পি) একটি মানব উন্নয়ন রিপোর্ট প্রকাশ করে। সাম্প্রতিক কালে এই বার্ষিক রিপোর্টে একটি বহুমাত্রিক দারিদ্র সূচক হিসাব করা হচ্ছে। এটি তৈরি করেছে অক্সফোর্ড পভার্টি অ্যান্ড হিউম্যান ডেভলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ। আয় বা ভোগব্যয়ের প্রচলিত মাপকাঠি ছাড়াও এতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয়ের হিসাব নেওয়া হয়। এই সূচক অনুসারে, ভারতে দারিদ্র প্রধানত কেন্দ্রীভূত কয়েকটি রাজ্যে: বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মধ্যপ্রদেশ ও পশ্চিমবঙ্গ। আবার রাজ্যের ভিতরেও তারতম্য আছে। যেমন, উপরোক্ত বহুমাত্রিক দারিদ্রের হিসাব কষা হয়েছিল সারা দেশের ৩৭৯টি অনগ্রসর জেলায়। এই জেলাগুলির অধিকাংশ যে সব রাজ্যে পড়েছে সেগুলি হল: বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, অসম, ওড়িশা ও রাজস্থান।
ভারতে দারিদ্রের মাত্রা কেমন, তার একটা ছবি পাওয়া গেল। কিন্তু দারিদ্র দূর করার জন্য কী করণীয়? আমরা পরের লেখায় সেই বিষয়ে আলোচনা শুরু করব।

দিল্লিতে সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ-এ অর্থনীতিবিদ


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.