|
|
|
|
পুরনো কোট নতুন কিস্সা
আজ জাতীয় পুরস্কারের স্পেশাল মেনশন খেতাব নিতে দিল্লিতে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি।
তার আগে কলকাতায় বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত-র ছবির শ্যুটিংয়ের মাঝে ফিরে গেলেন
পুরনো ‘কহানি’-র ‘তলাশ’য়ে। সাক্ষী প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত |
এ যেন নতুন করে বলা ‘ফির তেরি কহানি ইঁয়াদ আয়ি’!
যদিও নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকি এই নামের সিনেমাটা দেখেননি। কিন্তু ‘কহানি’র স্মৃতি ঝালিয়ে নিতে আপত্তি নেই তাঁর।
শুক্রবার যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি ভবনে। জাতীয় পুরস্কার স্পেশাল মেনশনের খেতাব নিতে। তার আগে ফিরে দেখা। যেখান থেকে তাঁর উত্থান শুরু!
মোনালিসা গেস্ট হাউজে যাওয়ার প্রস্তাব শুনে কেমন যেন নস্টালজিক হয়ে পড়লেন নওয়াজ। কলকাতাতেই প্রায় এক মাস ধরে শ্যুটিং করছেন নওয়াজ। সুজয় ঘোষের ইন্সপেক্টর খান এখন বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের আনোয়ার। কিন্তু বুদ্ধদেবের ‘আনোয়ার কা আজব কিস্সা’-র শ্যুটিং-এর ফাঁকে এক দিনও সময় করে উঠতে পারেননি তাঁর পুরনো শ্যুটিং স্পটে গিয়ে ফিরে দেখার।
ইচ্ছে ছিল। তবে একটাই অসুবিধা। গায়ে বেশ জ্বর। প্রায় ১০৩ টেম্পারেচর। মাথায় জলপট্টি দিতে হচ্ছে। তার মাঝে ট্যাক্সি চেপে পূর্ণদাস রোডের গেস্ট হাউজ থেকে শরৎ বোস রোড যাওয়াটাও বেশ কঠিন।
“আচ্ছা, দশ মিনিটের মধ্যে ঘুরে আসতে পারব?” প্রশ্ন করেন নওয়াজ।
ইতিবাচক উত্তর শুনে আর অপেক্ষা করেননি। ফিরে দেখার নেশাটা বোধহয় এ ভাবেই পেয়ে বসে।
ট্যাক্সি চলতে থাকে।
“আরে ওই তো... ওই জায়গাটাতে আমার জীবনের প্রথম ফোটোশ্যুট করা,” উত্তেজিত গলায় বলে ওঠেন।
তার পর নেমে পড়েন রাস্তায়। খুঁজতে থাকেন সেই পুরনো একটা ল্যান্ডমার্ক, যেখানে বসে ছবি তুলেছিলেন।
“জীবনটা কেমন অদ্ভুত ভাবে পাল্টে গেল আমার। এমনকী ওই ল্যান্ডমার্কটাও আর নেই যেখানে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছিলাম...” উদাস গলায় বলেন নওয়াজ।
মোনালিসা গেস্ট হাউজে ঢুকতে গিয়ে কেমন অদ্ভুত একটা লাগে তাঁর। বলেন, “এটা এমন অনুভূতি যা আমি ব্যক্ত করতে পারব না। জীবনে এ রকম কিছু মুহূর্ত আসে যখন বিহ্বল লাগে নিজেকে। গেস্টহাউজের ভিতরে গিয়েও আমার ঠিক সে রকমই লাগছে।” |
|
আর তার পর গল্প করতে থাকেন কী ভাবে তাঁর জীবনের ‘কহানি’টাই পাল্টে গিয়েছে এক বছরে।
গত বছর কান চলচ্চিত্র উৎসবে নওয়াজউদ্দিনের দু’টো ছবি দেখানো হয়েছিল। ‘মিস লাভলি’ আর ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’। তখন ফ্যাশন দুনিয়ার কেউ নওয়াজকে সে ভাবে চিনতেন না। কোনও ডিজাইনার তাঁকে একটা স্যুটও ধার দিতে চাননি যেটা পরে যেতে পারেন কান-য়ের রেড কার্পেটে।
আর এ বছর?
তাঁর তিনটে ছবি দেখানো হবে কান-য়ে। ‘মনসুন শ্যুট আউট’, ‘ডাব্বা’ আর ‘বম্বে টকিজ’। তিনি নিজেও আমন্ত্রিত উৎসবে।
বুদ্ধদেবের ছবির শ্যুটিং ৬ মে শেষ করে ফিরে যাবেন মুম্বইয়ে। সেখান থেকে সোজা কান। কিন্তু মজার ব্যাপার হল এ বার তাঁর মোবাইলের ইনবক্স উথলে পড়ছে ডিজাইনারদের মেসেজে!
“দেখুন না কী লিখছে,” বলে মোবাইল থেকে মেসেজ পড়ে শোনান।
কেউ বলছেন, নওয়াজ যদি একটা সুযোগ দেন তা হলে তাঁরা ওঁর জন্য এখনই স্পেশাল স্যুট বানিয়ে দেবেন।
কেউ বলছেন স্টাইলিস্ট লাগলে তাঁরা হাসিমুখে কাজ করতে রাজি। এমনকী বিদেশের নামী ব্র্যান্ডের ভারতীয় প্রতিনিধিও মেসেজ পাঠিয়েছেন।
তা নওয়াজ কী করবেন এখন?
“আরে, কী আবার করব? আগের বার পাড়ার দর্জি দিয়ে একটা কোট বানিয়েছিলাম। সেটাই তো বাড়ির আলমারিতে রয়েছে। ওটাই পরে যাব এ বার!” আর ওই ডিজাইনারদের অনুরোধের কী হবে? “কী আর হবে? আমার এ সব কিছুতে যায় আসে না। বারো বছর স্ট্রাগল করেছি। আমার সমসাময়িক অনেক অভিনেতাকে দেখেছি স্টার হতে। আবার তাঁদের পড়তেও দেখেছি। এ সব বাহ্যিক জিনিসে যদি আমি নিজেকে পাল্টে ফেলি তা হলে তো কোনও মানেই হয় না। কেউ কেউ ভাবেন যে স্টারডম বুঝি চিরসত্যি। কিন্তু আমি জানি এটা ঠিক নয়। তাই সব সময় নিজেকে এটা মনে করিয়ে রাখি,” বলছেন নওয়াজ।
‘কহানি’র সহ-অভিনেত্রী বিদ্যা বালন আজ কান জুরিতে। ‘কহানি’ থেকে কান-য়ের এই যাত্রার কথা ভেবে আজ কেমন লাগে? “এটা ‘আজব কিস্সা’ই বটে! বিদ্যার সঙ্গে কান-য়ে দেখা হবে আমার। ওর নিজের জন্য একটা অন্য রকমের ইমেজ তৈরি করেছে। কোনও র্যাট রেসে নেই। কোয়ালিটি ছবি করে। আমিও চাই বিদ্যার রাস্তা ধরেই চলতে,” নওয়াজ জানান।
তবে এই যাত্রার মাঝেই কিছু অদ্ভুত ঘটনাও ঘটে। এই তো সে দিন হঠাৎ এক জন বলে বসেন তাঁকে ছবির প্রচারে যেতে। “আমি জিজ্ঞাসা করি কোন সিনেমার প্রচার? উত্তর আসে ‘গ্যাংস অব গারদুলে’। আমি কিছুতেই মনে করতে পারি না ছবিটা। তার পর জানতে পারি যে ছ’বছর আগে একটা শর্ট ফিল্মে অভিনয় করেছিলাম। ড্রাগসের উপর, নাম ছিল ‘দ্য ফ্যাক্ট’। সেই ছবির পরিচালক শর্ট ফিল্মটাকে লম্বা করে ফিচার ফিল্ম বানিয়ে ফেলেছেন। কিছু নতুন অভিনেতা ঢুকিয়ে একটা অদ্ভুত সি-গ্রেড ছবি তৈরি করেছেন। আর আমাকে বলছেন ওটার জন্য আমি যেন প্রচারে যাই! এই রকম ষাট থেকে সত্তরটা শর্ট ফিল্ম আমি করেছি। সবাই যদি এখন এই রকম করেন, তা হলে আমার কী করার আছে বলুন তো?”
হাসি পায়। বিস্ময়ও লাগে।
তবে নওয়াজ বিচলিত নন। |
কলকাতার গেস্ট হাউসে হঠাৎ রাঁধুনির ভূমিকায় নওয়াজ।
বলেন, “নানা ধরনের চিকেন রান্না করতে ভালবাসি আমি” |
বরং কথা বলতে চান শুক্রবারের জাতীয় পুরস্কার অনুষ্ঠান নিয়ে। তার অভিনীত চারটি ছবি- ‘কহানি’, ‘গ্যাংস অব ওয়াসিপুর’, ‘দেখ ইন্ডিয়ান সার্কাস’ আর ‘তলাশ’-এর জন্য এ বছর জাতীয় পুরস্কারে তাঁকে দেওয়া হবে স্পেশাল মেনশন। ‘আনোয়ার...’-এর শ্যুটিংয়ের মাঝে দিল্লি যাচ্ছেন তিনি। “চারটে ছবির জন্য এই পুরস্কার। আমি আমার অ্যাওয়ার্ডটা আমার চারজন পরিচালককে উৎসর্গ করতে চাই সুজয়, অনুরাগ কাশ্যপ, মঙ্গেশ হালওয়ানে আর রিমা কাগতি। জাতীয় পুরস্কার নিতে গিয়ে অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গেও দেখা হবে আমার। তন্নিষ্ঠা চট্টোপাধ্যায়। ও আমার পুরনো বন্ধু। একসঙ্গে ‘দেখ ইন্ডিয়ান সার্কাস’ করেছি। ও-ও তো জাতীয় পুরস্কারে স্পেশাল মেনশন পাচ্ছে এ বার। আমার অভিনীত ছবি ‘চিটাগাঙ’য়ের পরিচালক বেদো (বেদব্রত পাইন) পুরস্কার পাচ্ছে। আমি জানি কী পরিমাণ যুদ্ধ করে ও ছবিটা বানিয়েছিল। বেদোকে আমি খুব সন্মান করি।”
তার পর গল্প করেন কী ভাবে আজও ভাল লাগে ‘চিটাগাঙ’য়ের ‘বোলো না’ গানটি। “গানটার চলচ্চিত্রায়ণ হয়েছে আমাকে আর ভেদাকে নিয়ে। কী অপূর্ব সুন্দর। স্নিগ্ধ। শান্ত। শঙ্কর মহাদেবন তো এটার জন্যও জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছেন। আজকাল সব ছবিতে দেখুন, কী ভাবে হিরোরা সব্বাই হিরোইনদের পিছনে ছুটছে। সেটাই যেন তাঁদের একমাত্র কাজ। আর বেদোকে দেখুন কী ভাবে একটা সম্পর্ককে ফুটিয়ে তুলেছে...”
এর মধ্যে দেখা হয় বুদ্ধদার সঙ্গে। শুরু হয় নওয়াজের আনোয়ার হওয়ার গল্প। “এত আনন্দ আমি কোনও চরিত্র করে আগে পাইনি। কত ছবির অফার এসেছে। কিন্তু আমি চিত্রনাট্য না পড়েই রাজি হয়েছিলাম এই চরিত্রটি করতে। আমি জানতাম বুদ্ধদা কী বড় মাপের পরিচালক। কিন্তু কাজ করে বুঝলাম যে, উনি খুব স্বতঃস্ফূর্ত। আর ওঁর মনটা একেবারে সতেজ। আমি হয়তো অভিনয় করতে গিয়ে বললাম, কেমন হয় যদি সিনটা এ ভাবে শ্যুট করা যায়? ওমনি দেখি বুদ্ধদা সব পালটে দিয়ে আমার সাজেশন অনুযায়ী শ্যুট করতে রাজি। এটা আমার কাছে একটা বিশাল প্রাপ্তি। বাংলাটা বলতে পারি না এখনও। তবে বুঝতে পারি,” নওয়াজ বললেন।
বুদ্ধদেব বলেন একজন ভাল অভিনেতা পরিচালককে অনুপ্রেরণা দিতে পারে। “এটা আমি নওয়াজের মধ্যে দেখেছি। আর দেখেছিলাম মিঠুনের মধ্যে। দু’টো ছবি করেছিল আমার সঙ্গে। একবার একটা ছবি করতে গিয়ে মিঠুন অন্য ভাবে শ্যুট নেওয়ার কথা বলে। আমার চিত্রগ্রাহক হাত তুলে দেন। কিন্তু মিঠুন নাছোড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত আমি নিজে ক্যামেরা ধরি। আর সেই শটটা কী দারুণ হয়েছিল। নওয়াজও আমাকে এ ভাবেই অনুপ্রেরণা দিয়েছে। সেটে ও সবার বন্ধু হয়ে গিয়েছে,” বুদ্ধদেব বলেন।
বলতে না বলতেই ছবির স্প্যানিশ চিত্রগ্রাহক দিয়েগো এসে ইয়ার্কি করে নওয়াজকে বলেন, “কী, শুনলাম জ্বরে নাকি তুমি সিগারেট ছেড়ে দিয়েছ?”
নওয়াজের মুচকি হাসি। “না না। একটা দাও, প্লিজ।” শ্যুটিং করতে করতে দিয়েগোর সঙ্গে নওয়াজের বন্ধুত্ব হয়ে গিয়েছে। “দু’জনে কান-য়ে যাচ্ছি। আমার একটা আমেরিকান ছবি আছে কান-য়ে,” বলেন দিয়েগো। |
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত, সোহিনী দাশগুপ্ত ও অনন্যা চট্টোপাধ্যায় |
তবে নওয়াজ ঠিক করে নিয়েছেন যে, ‘আনোয়ার...’ শ্যুটিং করে প্রায় ২৫ দিন মতো একটা লম্বা ব্রেক নেবেন। “আমার স্ত্রী আমাদের মেয়েকে নিয়ে কাশ্মীর বেড়াতে গিয়েছে। অনেক বার বারণ করেছিলাম এই সময়ে কাশ্মীরে না যেতে। কিন্তু স্ত্রীরা কি আর কথা শোনেন?” বলেই এক গাল হাসি।
তবে শ্যুটিংয়ের সময় নওয়াজের কাজ ছাড়া আর কিছুতেই মন থাকে না। “তাই বোধ হয় ওরা ছুটিতে গিয়েছে। আগে একটা ছবি করলে আমি সম্পূর্ণ ভাবে আমার চরিত্রের মধ্যে ঢুকে যেতে পারতাম। এক কোনায় গিয়ে চুপ করে বসে ভাবতাম নিজের চরিত্র নিয়ে। কিন্তু এখন সে বিলাসিতা থাকে না। তবে আনোয়ার করে আমার মধ্যে একটা অদ্ভূত বদল এসেছে। এমনিতে আমি কুকুর ভয় পাই। এ ছবিতে আমি কিন্তু সুন্দর একটা কুকুরের সঙ্গে কত সিন করেছি। কথা বলেছি। এমনকী একটা ‘ঘটিয়া’ নাচও করেছি! তবে ছবির ব্যকগ্রাউন্ড মিউজিকটা আমি সারাক্ষণ শুনি। বুদ্ধদার মেয়ে অলকানন্দা সুর করছে,” বলেই ট্যাবে সুরটা শুনিয়ে দিলেন।
“ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে কথা থাকে না। সেটা শুনলেই আমি চরিত্রের সঙ্গে একাত্মবোধ করি,” বলেন নওয়াজ।
মিউজিক বাজতে থাকে।
এর মধ্যে নতুন ছবি সই করেননি তিনি? “অনুরাগ কাশ্যপের প্রযোজনায় একটা ছবি করব হয়তো। একটা ছোট শহরের মানুষের গল্প। কী হয় সে যখন মুম্বইতে এসে পৌঁছয়। আর একটা ভাল ছবির অফার এসেছে। ‘মাসুম’ ছবিটার রিমেক হচ্ছে। আমাকে বলা হয়েছে নাসিরউদ্দিন শাহের চরিত্রটি করতে। ‘মাসুম’ আমার অত্যন্ত প্রিয় ছবি। কিন্তু নাসির স্যারের চরিত্রটা বলেই একটু ভয় হচ্ছে।”
নিজের জীবনে যদি ওই রকম একটা সঙ্কট আসত? তা হলে কী করতেন নওয়াজ? “পিতা হিসেবে আমি সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিতাম। আই উড বি আ রেসপনসিবল ফাদার।”
তার পর একটা মজার ‘কিস্সা’ শোনান নিজের মেয়েকে নিয়ে।
কিছু দিন আগে টিভিতে নওয়াজের আড়াই বছরের মেয়ে ‘তলাশ’ দেখছিল। ছবির শেষ দেখে ভেবেছে, বাবা বোধহয় মারাই গিয়েছে। আর তার পর সে কী কান্না। তাঁর স্ত্রী শেষে ফোন করে নওয়াজকে বলেন যে, তিনি যেন মেয়েকে বোঝান যে তিনি বেঁচে আছেন!
খ্যাতির বিড়ম্বনাতে প্রাইভেসি বিসর্জন দিতে হয় অনেক সময়। তবে ‘কহানি’ থেকে ‘তলাশ’ পার করা নওয়াজ বুঝেছেন যে, পেশার প্রয়োজনে মেয়ের কাছে বেঁচে থাকার পরিচয়ও দিতে হতে পারে!
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল |
|
|
|
|
|