একমত পুলিশকর্তারা
পুলিশি তদন্তেও বরাবর খবরদারিই রেওয়াজ
শুধু সিবিআই কেন, যে কোনও তদন্তকারী সংস্থাই যদি শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা প্রভাবিত হয়, তবে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হতে বাধ্য বলে রাজ্যের পুলিশ কর্তারা অনেকেই মনে করেন। মঙ্গলবার সিবিআইকে রাজনৈতিক ‘চাপ’ থেকে মুক্ত হয়ে কাজ করার পরামর্শ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। তার প্রেক্ষিতে এ রাজ্যের প্রাক্তন পুলিশ কর্তাদের অনেকেই মুখ খুলেছেন। আর, বর্তমানেরাও বিষয়টি নিয়ে প্রাক্তনীদের সঙ্গে একমত। তবে ‘চাকরির স্বার্থে’ প্রকাশ্যে কিছু বলতে চাননি তাঁরা।
রাজ্যের এক বর্তমান পুলিশ কর্তা (ডিজি পদমর্যাদার) যেমন বলেছেন, “বৌবাজার বিস্ফোরণ মামলায় অনেক সিপিএম নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও তাঁদের রেহাই দেওয়া হয়েছিল। একই ভাবে অর্থলগ্নি কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্তে তৃণমূলের রাঘব বোয়ালদের বাঁচানোর চেষ্টা হচ্ছে।” কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার তুষার তালুকদার মনে করেন, “গোটা ব্যবস্থাটাই যেখানে ‘ধামাধরা’, সেখানে দু’একজন রুখে দাঁড়ালে একঘরে হয়ে পড়েন। যেমন নজরুল ইসলাম।” তুষারবাবুর মন্তব্যের সূত্র ধরে রাজ্যের বর্তমান এক পুলিশ কর্তা আবার রঞ্জিত কুমার পচনন্দা, মনোজ বর্মা, দময়ন্তী সেনের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, ‘কাজ’ করতে গিয়ে অপমানিত হওয়ার উদাহরণ রয়েছে বিস্তর। যখন যাঁরা ক্ষমতায় বসেছেন, পুলিশকে নিজের মতো করে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছেন বলে তাঁর মত। অথচ শাসকদের কিন্তু চাকরি খাওয়ার ক্ষমতা নেই। নিচু পদে নামিয়ে দেওয়ারও ক্ষমতা নেই। তুষারবাবুর কথায়, “বড়জোর অপছন্দের পোস্টিং দেবে, অপমান করবে। বেশির ভাগ পুলিশ কর্তাই এই হেনস্থার মুখোমুখি হতে চান না। তাঁরা আপস করেন।”
খোদ তুষারবাবুর বিরুদ্ধেও অবশ্য আপস করার অভিযোগ রয়েছে। বৌবাজার বিস্ফোরণ-কাণ্ডের সময় তুষারবাবুই ছিলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার। সিপিএম নেতাদের নাম না ঢোকানোর চাপের কাছে তিনি নতিস্বীকার করেছিলেন বলে রাজ্যের বর্তমান এক পুলিশ কর্তাই অভিযোগ করেছেন। এ ব্যাপারে তুষারবাবুর মন্তব্য, “আমাদের উপরে কোনও চাপ ছিল না। ওই ঘটনার সঙ্গে কোনও সিপিএম নেতার জড়িত থাকার প্রমাণ আমরা পাইনি।”
পুলিশ কি চাইলেই সরকারের হস্তক্ষেপ এড়িয়ে কাজ করতে পারে? এ ব্যাপারে কিন্তু দু’রকম মতই আছে।  সুপ্রিম কোর্ট এ দিন সিবিআইয়ের মতো তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক চাপমুক্ত হয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছে। সিবিআইয়ের এক সময়ের অধিকর্তা ও রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি অরুণপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বলেন, “কোনও তদন্ত যদি সরাসরি আদালতের তত্ত্বাবধানে থাকে, তা হলে সরকার সে বিষয়ে জানতে চাইলেও তাকে জানানো উচিত নয়। অন্যান্য মামলার তদন্তের ক্ষেত্রেও তদন্তকারী সরকারকে জানাতে আইনত বাধ্য নন। সারদা-কাণ্ডের তদন্তের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।”
রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিরেক্টর জেনারেল ভূপিন্দর সিংহ এ প্রসঙ্গে মনে করিয়ে দেন, “তদন্তকারী সংস্থা নিরপেক্ষ ভাবে কাজ করবে বলেই ফৌজদারি কার্যবিধিতে বলা হয়েছে।” কিন্তু ভূপিন্দর অস্বীকার করতে পারেননি যে, “সরকারের একটা তত্ত্বাবধান, নির্দেশের বিষয় সব সময়েই চলে আসে। তবে কোনও মামলার তদন্ত যখন আদালতের নির্দেশে শুরু হয়, তখন আদালতকেই সব কিছু আগে জানানোর নিয়ম।” অরুণপ্রসাদবাবুর পর্যবেক্ষণ, “এখন অনেক ক্ষেত্রে তদন্তকারীরা নেতা-মন্ত্রীদের খুশি করার জন্য আদালতকে কিছু জানানোর আগেই উপযাজক হয়ে প্রশাসনের একাংশকে তদন্তের অনেক গোপন বিষয় জানিয়ে দেন। এই ভাবে ওই অফিসারেরা শাসক দলের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন।”
বর্তমানে কর্মরত ডিজি পদমর্যাদার এক অফিসারের কথায়, “সারদা-কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্তে উঠে আসা অনেক তথ্য আগেভাগেই পেয়ে যাচ্ছে সরকার। অথচ এটা অত্যন্ত স্পর্শকাতর বিষয়। শাসক দলের অনেক নেতা-মন্ত্রীর নামেই অভিযোগ উঠেছে।” এডিজি পদমর্যাদার এক অফিসারের মন্তব্য, আমেরিকার মতো দেশে যে-মুহূর্তে মামলা রুজু হল, তখন থেকেই তদন্তের গোটা প্রক্রিয়া বিচারকের সরাসরি নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে আদালতে মামলা রুজু হলেও যতক্ষণ না চার্জশিট দেওয়া হচ্ছে, ততক্ষণ বিষয়টি আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত হয় না। রাজ্য পুলিশে কর্মরত আরও এক এডিজি পদমর্যাদার অফিসারও একমত। “পুলিশ তদন্ত করে ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে। সেখানে বলা আছে, তদন্তকারী অফিসার তাঁর সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্তার নির্দেশে চলবেন, তাঁকেই তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে অবগত করবেন। প্রশাসনকে তদন্তের বিষয়ে জানানোর কোনও প্রশ্নই উঠছে না। কিন্তু বাস্তবে এর উল্টোটাই হচ্ছে।” ডিজি পদমর্যাদার এক অফিসারের পরামর্শ, “রাজ্যের তদন্তকারী সংস্থাগুলির অফিসারদের নিয়োগ ও বদলির ক্ষমতা থাকতে হবে হাইকোর্টের হাতে। তা হলে তদন্তকারী সংস্থাগুলিকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করা যেতে পারে।” সেটা কি আদতে সম্ভব? ওই পুলিশ-কর্তা বলেন, “এ রকম করতে গেলেই ‘গেল গেল’ রব উঠবে যে, বিচারবিভাগ প্রশাসনের বিষয়ে অনধিকার প্রবেশ করছে।”
কলকাতার প্রাক্তন পুলিশ কমিশনার প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। তাঁর মতে, “পুলিশ সরকারকে কিছু না-জানিয়ে শুধু আদালতকেই সব কিছু জানাবে, আমাদের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা সে রকম নয়।” প্রসূনবাবুর ব্যাখ্যা, “পুলিশ কোন তদন্তে কত দূর এগিয়েছে, সেটা সরকারকে জানতে হবে। সরকার জনসাধারণের ভোটে নির্বাচিত, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ। সরকারকে এড়িয়ে পুলিশ কিছু করতে পারে না।”

এই সংক্রান্ত খবর...



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.