ব্যাগ গুছিয়ে...
অতল জলের রূপকথা
লটল করছে পরিষ্কার জল। গভীরতা বড়জোর দেড় মানুষ। আর পাড় থেকে রেলিং ধরে দাঁড়ালে একেবারে নীচ পর্যন্ত পরিষ্কার দেখা যায়। প্রবাল দ্বীপের প্রাণীরাজ্যের কোন প্রতিনিধি কী করছে তা দেখা যাচ্ছে খালি চোখেই। লাল, হলুদ, সবুজ, নীল মাছেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রবাল জঙ্গলের মধ্যে। কখনও এসে পড়ছে বিশাল আকৃতির মাছের ঝাঁক। আর তখন রংবেরঙের ছোটরা প্রবাল প্রাচীরের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে পড়ছে। প্রাণ বাঁচানোর সে কী চেষ্টা! খাদ্য-খাদকের লুকোচুরি দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে পড়েছিলাম। পিঠে একটা নরম হাত পড়তেই সম্বিত ফিরল।
রোজালিন হ্যারিস। আমাদের ট্যুর গাইড। রোজালিন বললেন, “সময় কম। তাড়াতাড়ি সব দেখে নাও।” রোজালিনের সঙ্গেই আমরা এসেছি নর্থ কুইন্সল্যান্ডে প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে মাথা তুলে দাঁড়ানো আশ্চর্য এক দ্বীপে। নাম তার গ্রিন অ্যাইল্যান্ড। দ্বীপের এক দিকে একটা সংরক্ষিত বনাঞ্চল আছে। তার জন্য দ্বীপটার নাম গ্রিন আইল্যান্ড। কিন্তু নামটা মানানসই কি না তা নিয়ে কিন্তু অনায়াসে একটা বিতর্ক বাধানো যায়। কেইর্নসের ফেরিঘাট থেকে ক্রজে চেপে আসার সময় দ্বীপ সম্পর্কে একটা অন্য ধারণা নিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু পৌঁছে মনে হল নামটা অন্য কিছু হলে ভাল হত।
ছবিটি শ্যারন লিভিংস্টোন-এর সৌজন্যে
কী নাম দিলে তা মানানসই হত পারিপার্শ্বিক দৃশ্যমালার সঙ্গে? নীল সমুদ্র, নীলাভ আকাশ, সোনালি বালি, লাল নীল, হলুদ, সবুজ রঙের মাছ, স্কুইড, বাদামি-কালোর বাটিপ্রিন্টের ছাপ দেওয়া পিঠওয়ালা কচ্ছপ, রুপোলি হাঙ্গর, হাল্কা বেগুনি কিংবা গোলাপি প্রবাল, লালচে ধূসর ঘুঘু পাখি। কোনটা ছেড়ে কোনটা বলব! যে কোনও একটা দিয়েই দ্বীপটির নামকরণ করা যায়। আমাদের চিনা সঙ্গী ইয়ং-এর পছন্দের নাম ‘রামধনু’। তাঁর স্ত্রী লুসির সেটা পছন্দ নয়। চেঁচিয়ে উঠলেন মহিলা, ‘বিস্ময়’। পাশ থেকে আরও কয়েকটা নাম ভেসে এল, ‘জলের রানি’, ‘শান্তির দ্বীপ’, ‘ভালবাসা’, ‘জলপরী’, ‘স্বর্গ’, ‘শান্তিভূমি’ ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু সব নাম সবার পছন্দ নয়। আমাদের ক্রুজের কর্মী জুলিয়া হেসে উঠলেন, “যখন এই দ্বীপের নামকরণ হয় তখন নিশ্চয়ই নাম নিয়ে এমন নানা মত এসেছিল। বিতর্ক এড়াতেই বোধ হয় নাম রাখা হয়েছে গ্রিন আইল্যান্ড।”
কেইর্নস থেকে আমাদের গ্রিন আইল্যান্ডে নিয়ে এসেছিল বিগক্যাট গ্রিন আইল্যান্ড রিফ ক্রুজ। পুরোপুরি বাতানুকূল ৩০ মিটার লম্বা আড়াইতলা ক্রুজ। তার মধ্যে বিনোদনের সব ব্যবস্থা রয়েছে। সকাল ৯টায় কেইর্নস ছাড়ার আগে ক্রুজ সংস্থার অন্যতম কর্তা শ্যারন লিভিংস্টোন বলছিলেন, “ওই দ্বীপে গিয়ে নিজেদের মনে হবে তুমি সমুদ্রেরই এক জন। ওখানে মাছ, কচ্ছপ, প্রবাল প্রাচীর, বড় বড় ঝিনুক সবাই তোমাকে অভ্যর্থনা জানাতে এগিয়ে আসবে। খাবার দিয়ে ওদের লোভ দেখাতে হবে না। ওরা নিজেরাই আসবে। দিনের শেষে ফিরে আসতে মন চাইবে না।”
অভিজ্ঞতাটা সেই রকমই কিন্তু হল। আমাদের পাঁচ ঘণ্টা থাকার কথা ছিল ওই প্রবাল দ্বীপে। মনে হচ্ছিল কিছুই যেন দেখা হল না। পাড় থেকে অগভীর সুমুদ্রে প্রবালের জঙ্গলে নানা জলজ প্রাণীর ঘর-সংসার খালি চোখেই দেখা যাচ্ছিল। সমুদ্রের গভীরের প্রাণী ও উদ্ভিদ জগতের সঙ্গে পরিচয় করার লোভনীয় সুযোগ আসতেই তা লুফে নিলাম। তিন ভাবে সমুদ্রের একেবারে নীচের দৃশ্যপট দেখার সুযোগ ছিল। সাবমেরিনে চেপে, গ্লাসবোটে সওয়ার হয়ে কিংবা নাকে-মুখে নল লাগিয়ে সাঁতার কেটে। দু’বছর আগে আর এক বার গ্রেট বেরিয়ার রিফে আসার সুযোগ হয়েছিল। সে বার নাকে-মুখে নল লাগিয়ে সমুদ্রে সাঁতার কেটে সুবিধা হয়নি। অনভ্যস্ত পরিবেশে বেশি ক্ষণ থাকতে পারিনি। তাই এ বার আর ওই পথে যাইনি। গভীর সমুদ্রের তলদেশের জগৎ দেখার জন্য অন্য দু’টি উপায়ই বেছে নিয়েছিলাম।
সাবমেরিন যখন একটু একটু করে সমুদ্রের নীচে নামছিল, জলের নীচের ছবিটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছিল। আমাদের সাবমেরিনের জানলার পাশ দিয়ে সাঁ করে চলে গেল তিনটি স্কুইড। তার পিছনে পিছনেই এসে হাজির হল একটি বিশাল আকারের কচ্ছপ। বুঝতে পারছিলাম ওই কচ্ছপের ভয়েই এমন দৌড় তিন স্কুইডের। এক সময় তিনটি স্কুইড লুকিয়ে পড়ল প্রবালের জঙ্গলের ভিতরে। তার পরে কী হল আর দেখার সুযোগ হয়নি। কারণ আমাদের সাবমেরিন তখন এগিয়ে গিয়েছে অনেকটাই।
সমুদ্রের তলার খাদ্যশৃঙ্খলটা ক্রমে পরিষ্কার হচ্ছিল চোখের সামনে। একেবারে ছোট মাছগুলির অবাধ গতি প্রবালের জঙ্গলে। প্রবালের জঙ্গলে আটকে থাকা অমেরুদণ্ডী ছোট ছোট প্রাণীদের খুঁজে বের করে তারা মধ্যাহ্নভোজ সেরে নিচ্ছিল। দেখা গেল মধ্যাহ্নভোজের জন্য প্রবাল প্রাচীরে জড়ো হওয়া লাল-কালো ডোরাকাটা এক ঝাঁক মাছের পিছনে পিছনে হাজির বেশ বড় আকারের কালচে এক ঝাঁক মাছ। তারা অপেক্ষা করছে ওই লালা-কালো ডোরাকাটা মাছগুলির জন্য। আর সেটা বুঝতে পেরে ছোট মাছগুলি ঘাপটি মেরে বসে আছে প্রবালের জঙ্গলে।
একটা সময় দেখলাম নীলচে সবুজের গা আর হলুদ লেজের একটা মাছের ঝাঁক সাঁ করে বেরিয়ে গেল সামনে দিয়ে। পুরো দলটা একটা বড় মাছের আকার নিয়েছে। তাদের পিছনে তাড়া করে আসছে বিশাল আকৃতির এক ঝাঁক বাদামী মাছ। বইতে কিংবা প্রাণীবিজ্ঞানের বিভিন্ন জার্নালে যা পড়েছি তার সঙ্গে এই দৃশ্যের হুবহু মিল। আসলে বড় মাছগুলিকে বিভ্রান্ত করতেই হলদে লেজের ছোট মাছগুলি নিজেদের সাজিয়ে নিয়েছে একটা বড় মাছের আকারে। বড় মাছগুলি ব্যুহ ভেঙে এগোতে সাহস পাচ্ছে না। কিন্তু সুযোগের অপেক্ষায় রয়েছে। ওই নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেঙে কোনও মাছ ছিটকে বেরিয়ে এলে ঝাঁপিয়ে পড়বে তারা।
কাচের সামনে এ বার এক এক ঝাঁক জেলিফিস। ছাতার রং কোনওটার নীলচে, কোনওটার বা সবুজ, কোনওটা বর্ণহীন। দেখতে নিতান্ত নিরীহ হলেও, তাদের ভয়ে কিন্তু সন্ত্রস্ত মানুষও। যাঁরা মুখে-নাকে নল গুঁজে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন তাঁদের পরতে হয়েছিল গা ঢাকা এক ধরনের পোশাক, জেলি ফিসের আক্রমণ থেকে বাঁচতে।
কেইর্নস থেকে রওনা দেওয়ার আগে ক্রুজ সংস্থার তরফে শ্যারন বার বার বলে দিয়েছেন, “গা ঢাকা পোশাক ছাড়া জলে কিন্তু সাঁতার কাটার জন্য নামবে না। জেলিফিশের শরীরের যে অংশগুলি ছাতার বাঁটের মতো ঝোলে তার স্পর্শ কিন্তু মারাত্মক। তাতে মিশে আছে মারাত্মক বিষ। তার ছোঁয়া লাগলে জীবন সঙ্কটেরও আশঙ্কা থেকে যায়। অতএব সাবধান।” চোখের সামনে জেলিফিস দেখে ভাবতে শুরু করেছিলাম ওদের মধ্যে কোনটা বয়ে বেড়াচ্ছে মারাত্মক বিষ। অজান্তেই ক্যামেরা সরিয়ে নিয়েছিলাম জানলার কাচ থেকে।
গ্রিন আইল্যান্ডের একেবারে পাড়ের কাছে যেখানে জল অগভীর সেখানে কোমর জল পর্যন্ত নেমে যাওয়া যায় অনায়াসে। পরিষ্কার জলের তলায় কোথাও দেখা যাবে বিশাল ঝিনুক সন্ন্যাসীর মতো স্থির হয়ে ঘুমোচ্ছে। তার পাশ দিয়ে দৌড়ে যাচ্ছে ছোট ছোট মাছের ঝাঁক। ভাগ্য ভাল থাকলে হাঙরের বাচ্চাদের দেখা যায় পাড়ের কাছে। আমি দেখিনি। কিন্তু আমাদের গাইড রোজালিন ওই বাচ্চা হাঙড়ের দল দেখে শিশুর মতো লাফিয়ে উঠেছিলেন। চেঁচিয়ে আমাকে ডেকেও ছিলেন। কিন্তু আমি তখন মাছেদের খেলা দেখতে ব্যস্ত। রোজালিনের কাছে পৌঁছতে পৌঁছতে হাঙরের দলটা মিলিয়ে গেল প্রবাল প্রাচীরের পিছনে। অনেক ক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়েছিলাম দৃষ্টি স্থির রেখে। কিন্তু ওদের আর দেখিনি।
এই আফশোসটা নিয়েই শেষ পর্যন্ত বেরোতে হল গ্রিন আইল্যান্ড থেকে। ফেরার পথে ইতালির নরওয়ের পরিবেশ বিজ্ঞানী নেলসনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বলছিলাম আবার আসব এই দ্বীপে। এ বার স্ত্রী-পুত্র নিয়ে। নেলসন বললেন, “খুব বেশি দেরি কিন্তু করে ফেলো না। যে ভাবে আবহাওয়ার পরিবর্তন এই সমুদ্রের প্রাকৃতিক জীবনে পরিবর্তন আনছে তাতে সংবেদনশীল প্রবালপ্রাচীর কত দিন সেই চাপ নিতে পারবে তা বলা যাচ্ছে না।”
পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন কেইর্নসের আইনজীবী পিটার ম্যাক্সওয়েল। আমাদের আলোচনা শুনে একটু দাঁড়ালেন। নেলসনের কথার প্রতিধ্বনি পিটারের মুখেও, “অস্ট্রেলিয়ায় সব থেকে বেশি বৃষ্টি হয় আমাদের এই অঞ্চলেই। এ বার কিন্তু একেবারেই বৃষ্টি হয়নি। এটা গত কয়েক দশকের মধ্যে কেইর্নসে সব থেকে কম বৃষ্টির বছর।” পিটারের মুখের কথা ধরে নেলসন বললেন, “সমুদ্রের তাপমাত্রা এর ফলে বাড়বে। সামুদ্রিক প্রাণী আর উদ্ভিদের জীবনচক্রে তা প্রভাব ফেলবে। প্রবাল-রাও বাদ যাবে না।”
ফেরার পথে মনটা খারাপ হয়ে গেল খুব। ক্রজের পিছনের ডেকে গিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলাম সুন্দরী গ্রিন আইল্যান্ডের দিকে। একসময় তা হারিয়ে গেল দৃষ্টিপথ থেকে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.