শাবকটিকে একলা ফেলে রেখে আগেই ফিরে গেছে দলের বাকিরা। ফেরেনি শুধু মা। চৌবাচ্চায় পড়ে যাওয়া বাচ্চাকে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। শেষে ঘুমপাড়ানি গুলিতে তাকে কাবু করে তার ছানাকে মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে স্বস্তি ফিরেছে বন দফতরের। সেই উদ্ধার পর্বের মাঝেই অবশ্য মা হাতি পায়ে পিষে মেরেছে এক যুবককে।
বাঁকুড়ার বড়জোড়ায় শুক্রবার সকাল থেকে এই ঘটনার সাক্ষী রইলেন অনেকে। বড়জোড়ার জঙ্গলে প্রায় চার মাস ধরে দাপাচ্ছে দলমার ১৫০টি হাতির দল। বৃহস্পতিবার মাঝরাতে বড়জোড়া রেঞ্জ অফিসের নার্সারিতে ঢুকে পড়ে এই দলটি। রাত ২টো নাগাদ নার্সারির মধ্যে ৭ ফুট গভীর ও ১২ ফুট চওড়া চৌবাচ্চায় মাস দুয়েকের হস্তিশাবক পড়ে যায়। চৌবাচ্চার অর্ধেকটা জলভর্তি ছিল। শাবকটিকে তোলার চেষ্টা শুরু করে হাতির দল। বনকর্মীরা চলে আসায় জঙ্গলমুখো হতে শুরু করে হাতির পাল। কিন্তু, সন্তানকে ছেড়ে জায়গা ছাড়েনি মা হাতিটি। দিনের আলো ফুটতেই ভিড় জমাতে থাকেন বড়জোড়া-সহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা। শাবকটিকে তুলতে বিভিন্ন ভাবে চেষ্টা শুরু করে হস্তিনীটিও। |
উদ্ধার কাজে ব্যস্ত দমকল ও বনকর্মীরা। ছবি: অভিজিৎ সিংহ |
কখনও শুঁড়ে জড়িয়ে, কখনও বা চৌবাচ্চায় পা নামিয়ে বাচ্চাকে উঠতে সাহায্য করার মরিয়া চেষ্টা করছিল মা। ওই অবস্থাতেই বাচ্চাকে সে দুধ খাইয়েছে। শাবককে ভাসিয়ে উপরে তোলার জন্য চৌবাচ্চায় জল বাড়াতে একাধিকবার মূত্রত্যাগও করে মা হাতি। লোকজন কাছাকাছি ঘেঁষতে গেলে তাদের দিকে তেড়েও যায় সে। স্থানীয় লহড়াবনী গ্রামের বাসিন্দা শ্রীকান্ত ঘোষ (৩৭) অতি উৎসাহে হস্তিনীটির একেবারে কাছাকাছি চলে যান। নিমেষে ওই যুবককে পায়ে পিষে ফেলে হস্তিনী। বনকর্মীরা তাঁকে উদ্ধার করে বাঁকুড়া মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত বলে ঘোষণা করা হয়। ইতিমধ্যে বন দফতরের দল ও দুর্গাপুর থেকে একটি ইঞ্জিন নিয়ে হাজির হন দমকলকর্মীরা। ততক্ষণে মা হাতির প্রায় পাগলপারা দশা। বনকর্মীরা বুঝতে পারেন, ঘুমপাড়ানি গুলি ছাড়া হস্তিনীকে কাবু না করা পর্যন্ত তার সন্তানকে উদ্ধার করা সম্ভব নয়। সকাল ন’টা নাগাদ প্রথমবার ঘুমপাড়ানি গুলি করা হয় হস্তিনীটিকে। ঘুমের ইঞ্জেকশন শরীরে ঢুকতেই উত্তেজিত হয়ে দর্শকদের দিকে তেড়ে যায় হাতিটি। বেশ কিছু বনকর্মীও সেই সময় ভয়ে এ দিক ও দিক ছুটতে শুরু করেন। যদিও বাচ্চার চিৎকার শুনে ফের তার কাছে ফিরে যায় মা হাতি।
কিছু পরে ঝিমুনি শুরু হতেই মা হাতি শরীরে কাদা ও জল মাখতে থাকে। বড়জোড়ার বিট অফিসার রাজেশ দাস বলছিলেন, “নিজের সন্তানের বিপদ বুঝে মা হাতি কোনও মতেই হুঁশ হারাতে চাইছে না। তাই ওষুধও কাজ করছে না।” এক ঘণ্টা পরে দ্বিতীয় বার ঘুমপাড়ানি গুলি করা হয় হস্তিনীটিকে। আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পাথরের মূর্তির মতো চৌবাচ্চার এক পাশে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। বন ও দমকলকর্মীরা উদ্ধার কাজ শুরু করেন। মিনিট কুড়ির মধ্যেই জল দিয়ে চৌবাচ্চা ভর্তি করে সেটির দেওয়ালের এক দিক ভেঙে বাঁশের সাহায্যে হস্তিশাবকটিকে উদ্ধার করা হয়।
ডিএফও (বাঁকুড়া উত্তর বন বিভাগ) এস কুলন ডেইভালের কথায়, “শাবকটি একবার মানুষের সংস্পর্শে এলে মা তাকে ফিরে নেবে নাএই আশঙ্কা ছিল। তাই উদ্ধারকর্মীদের বারবার সতর্ক থাকতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত শাবকটিকে তার মা ফিরিয়ে নিয়েছে, দু’জনেই সুস্থ অবস্থায় জঙ্গলে ফিরে গিয়েছে।” |