|
|
|
|
তারাবাজি |
আহত সিংহের নাম সিএসকে |
নামটা মহেন্দ্র সিংহ ধোনিও হতে পারে। লিখছেন যুধাজিৎ দত্ত |
গত শনিবার। চেন্নাই সুপার কিংস-য়ের আইপিএল সিক্সের প্রথম ম্যাচ।
আর প্রথম ম্যাচেই হার মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের কাছে। আবারও হার দিয়ে শুরু করতে হল চেন্নাই সুপার কিংস-য়ের আইপিএল যাত্রা।
সাড়ে ছ’ফুটের কায়রন পোলার্ড বাউন্ডারি লাইনে না থাকলে হয়তো এই লেখার অ্যাঙ্গেলটাই বদলে যেত।
সে ভেবে আর কী হবে? আর আইপিএল-য়ের প্রথম ম্যাচে হারা তো চেন্নাই সুপার কিংস-য়ের নতুন নয়।
ছ’টা আইপিএল-য়ের মধ্যে এই নিয়ে চারটেরই প্রথম ম্যাচে হেরে শুরু করেছে চেন্নাই সুপার কিংস।
তবু দু’বার আইপিএল চ্যাম্পিয়ন। দু’বার রানার্স আপ।
শনিবারের ম্যাচের পর কথা হচ্ছিল। কলকাতার একজন বললেন, “টিমের ম্যাসকটটা কিন্তু হান্ড্রেড পারসেন্ট পারফেক্ট। কথায় আছে না ‘আহত সিংহ সব সময় ভয়ঙ্কর’।”
ঠিক তো। চেন্নাই সুপার কিংস পুরোপুরি সিংহের মতো। এমনিতে মারাত্মক। হেরে গেলে ভয়ঙ্কর।
তবে টিম হারুক কী জিতুক, টিম মেম্বারদের বডি ল্যাঙ্গোয়েজে কোনও বদল দেখবেন না। প্লেয়ার, কর্মকর্তা, মালিক... কারওর উপর কোনও ছাপ দেখতে পাবেন না।
পাবেনই বা কী করে? টিমের অধিনায়কই যে স্বয়ং ‘ক্যাপ্টেন কুল’।
টিম ম্যানেজমেন্টও একই রকম। আগের বছরে হারের পরও পার্টির ব্যবস্থা করেছিল। প্রাইভেট পার্টি। অনেকেই হয়তো জানতে পারেনি। কিন্তু আসল কথা হল হারের পরেও টিমকে মুষড়ে পড়তে দেয়নি। |
|
টিমও তাই ‘কাম অ্যান্ড কুল’।
হারুক কী জিতুক, টিম মিটিংয়ের দৈর্ঘ্য ৫ মিনিটের বেশি হয় না।
এ বারও পোস্ট ম্যাচ মিটিংয়ে তার অন্যথা হয়নি। ধোনি বলল, “১৫০য়ের মধ্যে টার্গেটটা কোনও টার্গেটই নয়। ব্যাটসম্যানদের শট বাছাইয়ে ভুল ছিল। এটার আর রিপিট যেন না হয়।” ব্যস। এই হল টিম মিটিং।
এমনই টিম চেন্নাই সুপার কিংস। জয় হোক কী পরাজয়, কারও ব্যক্তিগত কৃতিত্ব বা ত্রুটি নয়। দায় গোটা টিমের।
সিএসকে-র স্পিরিটটাই এমন। এই তো এ বার আইপিএল শুরুর আগে সবাই মিলে ক্রুজে বেরিয়ে পড়ল করমণ্ডল কোস্ট ঘুরতে।
যদি ভাবেন, টিম মিটিং সংক্ষেপে হল তো কী? পরে নিশ্চয় সবাইয়ের খেলার আলাদা আলাদা করে বিশ্লেষণ করা হবে। তাহলে আপনি ডাহা ফেল। টিম মিটিংয়ের বাইরে ক্রিকেট নিয়ে একটা কথাও উঠবে না। নিজেদের মধ্যে আলোচনার সময়ও কখনও প্লেয়ারদের ম্যাচ নিয়ে কথা বলতে দেখিনি।
হ্যাঁ, অধিনায়কের দরজা সব সময় খোলা। প্লেয়াররা চাইলেই ঢুকে পড়তে পারে সেখানে। আলোচনা করতে পারে ম্যাচ নিয়ে। তবে আমি কখনও কারওকে দেখিনি ক্রিকেট নিয়ে আলোচনা করতে ধোনির রুমে ঢুকতে। ও সব বিশ্লেষণে ধোনি নেই। খবরের কাগজটাই তো ও পড়ে না। পাছে নিজের খেলার কাটাছেঁড়া পড়তে হয়।
তাই বলে কি হারটা বুকে বাজে না ‘হলুদ সিংহ’দের? নিশ্চয়ই বাজে। নিশ্চয়ই খারাপ লাগে। হারের পর হয়তো সবাই মিলে মন্দিরে পুজো দিতে যায় না। কিন্তু নিজের নিজের মতো করে একটা সংস্কার তৈরি করে নেয়।
একটা ঘটনা বলি। ২০১০ আইপিএল। পর পর চার ম্যাচ হারার পর বেশ কোণঠাসা চেন্নাই সুপার কিংস। ধোনি শেভ করা বন্ধ করে দিল। ট্রিম পর্যন্ত করাত না। ওই বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়ায়, সেটাই রিচুয়াল হয়ে দাঁড়াল। টিম খারাপ খেলা মানে শেভ বন্ধ ধোনির।
পরের বছর মুরলী বিজয়ের পারফর্ম্যান্স একটু খারাপ হতেই, মুরলীও ক্যাপ্টেনের পথে হাঁটল।
শুধু ক্রিকেটাররা নয়, গোটা টিমটাই আসলে এ ব্যাপারে একটু বাতিকগ্রস্ত। তৃতীয় আইপিএল-য়ে মুম্বইয়ে থাকার সময় টিম ছিল আইটিসি গ্র্যান্ড সেন্ট্রালে। টিম ভালই খেলছিল। লিগের মাঝামাঝি ওঠে ট্রাইডেন্টে। ম্যাচ হারল সিএসকে। কোপ গিয়ে পড়ল হোটেলে! তার পর থেকে এখন অবধি মুম্বইতে থাকা মানে টিমের ঠিকানা আইটিসি গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল।
আর একটা ঘটনাও মনে আছে। দ্বিতীয় আইপিএল। দক্ষিণ আফ্রিকায়। সেখানে এক সাউথ ইন্ডিয়ান ভদ্রলোকের কাছ থেকে খাবার নিয়ে আসত টিম ম্যানেজমেন্ট। কারণ তিনি নাকি টিমের পক্ষে খুব লাকি।
স্বাভাবিক ভাবেই সব সংস্কার ভাল ফল দেয় না। সে বারই তো সেমিফাইনাল থেকে বিদায় নিয়েছিল সিএসকে।হোটেল নিয়ে বাতিক থাকতে পারে। লাকি জায়গা থেকে খাবার নিয়ে আসায় ম্যানেজমেন্টের হাত থাকতে পারে। কিন্তু ক্রিকেট খেলায় ম্যানেজমেন্ট একটুও নাক গলায় না। এই ব্যাপারে চেন্নাই সুপার কিংস অন্য সব আইপিএল টিমের থেকে আলাদা। আমি প্রথম আইপিএল-য়ে কেকেআর-য়ের সঙ্গে ছিলাম। ওখানে কখনও দেখিনি ক্রিকেটারদের এতটা স্বাধীনতা দিতে। কিন্তু সিএসকে টিম ম্যানেজমেন্ট কখনওই ক্রিকেট নিয়ে নাক গলাবে না। ওটা ধোনি আর কোচ স্টিফেন ফ্লেমিংই-য়েরই ডিপার্টমেন্ট।
এটাও কিন্তু প্লেয়ারদের খাদের কিনারা থেকে ফিরে আসার একটা বড় কারণ। ক্রিকেটটা ক্রিকেটাররা দেখে, টিম ম্যানেজমেন্ট টিম ম্যানেজার। এতে দায়িত্ব নির্দিষ্ট থাকে। মুক্ত মনে নিজের কাজটা করা যায়। |
|
সিএসকে-র সাফল্যের আর এক মন্ত্র অবশ্যই টিম স্পিরিট। ক্রিকেটার হোক কী ফ্যান। টিম অন্ত প্রাণ সবার।
একটা ঘটনা বলি প্রথম আইপিএল-য়ের। তখন আমি কেকেআর-য়ের সঙ্গে যুক্ত। কেকেআর-য়ের জার্সি পরেই একদিন ঢুকে পড়েছিলাম ধোনির রুমে। অন্য টিমের জার্সি পরা লোক দেখেই বিগড়ে গেল ধোনির মেজাজ, বলেছিল, “অন্য টিমের জার্সি পরে কেন এসেছ?” ইয়ার্কি করে বললেও বিগড়ানো মেজাজটা পরিষ্কার।
আর ফ্যানদের ডেডিকেশন। চেন্নাই সুপার কিংস-য়ের বারবার বাউন্স ব্যাক করায় ফ্যানদের অবদান নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। এমন ফ্যান আমি কোথাও দেখিনি। টিম হারুক কী জিতুক, কখনও মুখ ফিরিয়ে নেবে না। জানেন কি, বেশ কিছু ফ্যানকে চেন্নাই সুপার কিংস নিজেদের খরচে দক্ষিণ আফ্রিকাতেও উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। অন্য শহরে তো নিয়ে যায়ই। তবে চুপিচুপি একটা গোপন খবর ফাঁস করে দিই, এটার পিছনেও কিন্তু আসলে সুপারস্টিশন। সিএসকে ম্যানেজমেন্ট মনে করে ওই ফ্যানরা নাকি টিমের পক্ষে লাকি!
আর ফ্যান সাপোর্ট সিএসকে-র ক্ষেত্রে বেশ স্বাভাবিক। এত স্থানীয় ক্রিকেটার অন্য কোন টিমে আছে! ‘সাউথ কানেকশন’ বরাবরই সিএসকে-র অস্ত্র।
মুরলী বিজয়, রবিচন্দ্রন অশ্বিন, বদ্রীনাথ তো সেই গোড়া থেকেই টিমে। এমনকী বাবা অপরাজিতের মতো তরুণ ব্রিগেডকে দলে টানা। ফলে ফ্যানরাও চিয়ার করার একটা ঠিকঠাক মানে পায়।
তবে শুরুতেই বলেছিলাম না চেন্নাই সুপার কিংস পুরোপুরি সিংহের মতো। না, কথাটা পুরোপুরি হবে না। অনেকটা সিংহের মতো।
কারণ এই সিংহ একা নয়, দল বেঁধে প্রতিপক্ষ দমনেই বিশ্বাসী। |
|
|
|
|
|