সর্বোচ্চ বিচারালয় শাস্তি দিয়াছে। সংবাদ ছড়াইয়া পড়িবামাত্র হাহাকার। বন্ধু-পরিজনরা চাহিতেছেন তাঁহার যেন শাস্তি না হয়। দেশের নাম ভারত: তাই নেতা-নেত্রীরাও ভগ্নহৃদয়ে মত দিতেছেন, আহা ছেলেটির মনে বড় কষ্ট, আহা ছেলেটির বন্ধুরা বড় ব্যথা পাইতেছে, আহা ছেলেটি ভুল করিয়া ফেলিয়াছে, উহার শাস্তি মকুব হউক, আদালত পুনর্বিবেচনা করুন! ছেলেটির মন এবং মনোব্যথা বিষয়ে এমন সহানুভূতির বন্যার কারণ: তিনি এক তারকা! বলিউডের তারকা। ভারতভূমির আপামর নাড়ির তার যেখানে বাঁধা, যাহার ঢেউয়ে আসমুদ্রহিমাচল আবেগজোয়ার উঠে এবং নামে, সেই অদ্বিতীয় বলিউডেরই পুত্র তিনি। দেশের নাম ভারত: তাই যেখানে রাস্তায় দুর্ঘটনা ঘটিয়া গেলে আহত ব্যক্তিকে কোনও পথচারী সাহায্য করিতে ভুলিয়াও পা বাড়ায় না, সে দেশে করুণাবন্যার এই ঘনায়মানতা বলিউডি মাহাত্ম্যই টানিতে পারে। আহা, তিনি যে অভিনয় করিয়াছিলেন! গুন্ডাগিরির অভিনয়, গাঁধীগিরির অভিনয়। তাঁহার জন্য দেশের প্রাণ কাঁদিবে না?
দেশের প্রাণ কাঁদে কাঁদুক। বলিউডের সহকর্মীরা সঞ্জয় দত্তের সহমর্মী হইবেন, তাহাতেও আপত্তির কিছু নাই। এমনকী ব্যক্তি হিসাবে তিনি গত দুই দশকে যে ধরনের ভাবমূর্তি অর্জন করিয়াছেন, তাহার ইতিবাচক দিকটিকে অস্বীকার করিবারও কোনও কারণ হয়তো নাই, তিনি হয়তো সত্যই নিজেকে সংশোধন করিয়াছেন। তাঁহার গুণমুগ্ধ না হইয়াও এই বিশেষ কারণে কেহ তাঁহার প্রতি সহানুভূতি পোষণ করিতে পারেন। ব্যক্তিগত বা নিতান্ত ঘরোয়া পরিসরে সেই অনুভূতি প্রকাশও করিতে পারেন। কিন্তু দেশের শাসনব্যবস্থায় তথা সরকারি কাঠামোয় তথা রাজনীতিতে যাঁহারা সক্রিয় ভাবে নিয়োজিত তাঁহারা এই সহানুভূতির প্রকাশ্য প্রচারে শামিল হইলে প্রশ্ন ওঠে। বড় রকমের প্রশ্ন। নীতির প্রশ্ন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হইয়া কিংবা কেন্দ্রীয় সরকারের প্রধান শরিক দলের নেতা হইয়া দিগ্বিজয় সিংহ, অথবা অমর সিংহ বা রাজ ঠাকরের মতো সম্মুখ সারির রাজনৈতিক নেতারা কোন যুক্তিতে সঞ্জয় দত্তের শাস্তি মকুবের প্রার্থনা জানাইতে পারেন?
পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যুক্তি দিতে পারেন, তিনি তো নিজস্ব বৃত্তেই এই অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, ফেসবুকে মন্তব্য করিয়াছেন, ইহা তাঁহার ব্যক্তিগত পরিসর। একটি গোড়ার কথা এখানে স্পষ্ট হওয়া দরকার। যিনি রাজনৈতিক উচ্চপদে আসীন, প্রশাসনিক ভারপ্রাপ্ত, তিনি কিন্তু এমনকী ব্যক্তিগত পরিসরেও এমন কিছু ভাবিতে বা করিতে পারেন না যাহা দেশের সংবিধানের মূল নীতি বা আদর্শের পরিপন্থী। তাহা ব্যতীত, ফেসবুককে তো আর সত্যই ব্যক্তিগত পরিসর বলা চলে না। ইহা নূতন যুগের ‘পাবলিক স্পেস’, যেখানে জননেতাকে তাঁহার দায় বহন করিয়াই চলিতে হইবে। তিনি যদি রাজনৈতিক প্রচারে এই পরিসর ব্যবহার করিতে পারেন, তবে এই ক্ষেত্রে তাঁহার ‘একান্ত’ মতপ্রকাশও কিন্তু ‘প্রচার’ বলিয়াই গণ্য হইবে। গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত জননেতাদের জানা দরকার, অপরাধী প্রমাণিত হইবার পর কোনও মুন্না কিংবা মুন্নাভাই-কে অন্যদের অপেক্ষা আলাদা করিয়া দেখিবার অধিকার তাঁহাদের নাই। দেশের আইনব্যবস্থা ও বিচারব্যবস্থাকে মান্য করিয়া চলিতে তাঁহারা বাধ্য।
একই সঙ্গে এ কথাও তাঁহাদের বুঝিয়া লওয়া প্রয়োজন যে, জনজীবনে যোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাঁহারা আপন ব্যক্তিগত পরিসরের স্বাতন্ত্র্য জনপরিসরের নিকট সমর্পণ করিয়াছেন, তাঁহাদের ‘ব্যক্তিগত’ মতামত বা রুচি-পছন্দ বা আবেগ-অনুভূতির প্রকাশ সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত পরিসরে সীমিত রাখা বাঞ্ছনীয়, সেগুলি কোনও অবস্থাতেই বাহিরে প্রকাশ করা উচিত নয়, তাহার কোনও নৈতিক অধিকার তাঁহাদের নাই। এবং, যেহেতু তাঁহারা নেতৃস্থানে, সুতরাং আপন নৈতিকতার মান উন্নত এবং অকলঙ্ক রাখিবার দায়িত্ব তাঁহাদেরই। ইহা আইনের প্রশ্ন নয়, বাহির হইতে আরোপিত নিষেধাজ্ঞার ব্যাপারও নয়, এখানেই আপনি আচরি ধর্ম সমাজকে শিখাইবার গুরুত্ব। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়রা আপন গুরুত্ব বোঝেন কি না, তাহা অবশ্য বলা কঠিন। |