এ-ও এক পরিবর্তন।
শ্রমিক শ্রেণির একনায়কতন্ত্রের চিনে সে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের স্ত্রীকে মার্কিন কায়দায় ‘ফার্স্ট লেডি’-র বিশ্ব-মর্যাদা প্রদান!
কমিউনিস্ট পার্টিতে ব্যক্তির ভূমিকা নিয়েই সাবেকি রক্ষণশীলতা ছিল। আর নতুন প্রেসিডেন্টের স্ত্রী পেং লিউয়ান যে আধুনিক ডিজাইনের কালো কোটটি পরে রাশিয়া গেলেন, হাতে যে চামড়ার ব্যাগটি ব্যবহার করলেন, চিনের মেয়েরা এখন সেই ডিজাইনের ব্যাগ কিনতে পাগল। এ এক নতুন চিন!
৫০ বছরের পেং লিউয়ান নিজে বিখ্যাত গায়িকা। চিনা লোকসঙ্গীত ও পপ সঙ্গীতের ‘ফিউশন’ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান। আর এখন তিনি পৃথিবীর নানা প্রান্তে চিনের ফার্স্ট লেডি হিসেবে দেশের সাংস্কৃতিক রাষ্ট্রদূত! রাশিয়ায় প্রেসিডেন্টের সঙ্গে গিয়ে তিনি গোটা দুনিয়ায় শুধু যে হইচই ফেলে দেন তা নয়, চিনের সরকারি টিভি চ্যানেল, সংবাদপত্র এমনকী ইন্টারনেট-ইউ টিউবে সর্বত্র তাঁর রাশিয়া সফরের ‘ফুটেজ’। ইন্টারনেটে দারুন জনপ্রিয় ফার্স্ট লেডি। দক্ষিণ আফ্রিকার সৈকত-শহরে এসে পেং লিউয়ান একটি গানের অনুষ্ঠান করেছেন। প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনের স্ত্রী হিলারি বা ওবামা-পত্নী মিশেল যে ভাবে এড্স বা যক্ষ্মা-বিরোধী রাষ্ট্রপুঞ্জের প্রচারের দূত হন, করছেন সেই কাজটাও। |
চিনের ফার্স্ট লেডি পেং লিউয়ান। মঙ্গলবার প্রিটোরিয়ায়। ছবি: রয়টার্স |
চিনের কমিউনিস্ট দলের বিধি অনুসারে পলিটব্যুরোই সব। চিনের কোনও প্রেসিডেন্টের স্ত্রী অতীতে এত প্রচার পাননি। মাও জে দং-এর স্ত্রী জিয়াং কুইং সক্রিয় রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাঁকে প্রকাশ্যে কখনওই দেখা যেত না। মাও-এর মৃত্যুর পর অবশ্য রাষ্ট্র তাঁকে অপরাধ দমন বিরোধী আইন অনুসারে জেলে পাঠায়। কারণ তিনি ছিলেন সেই ‘গ্যাং অফ ফোরে’র প্রধান নেপথ্য শিল্পী।
এর আগের প্রধানমন্ত্রী ওয়েন জিয়াবাওয়ের স্ত্রী রত্ন ব্যবসায়ী ছিলেন। বিশেষ ধনীও ছিলেন। কিন্তু সরকারি প্রচার? নৈব নৈব চ। তিনিও দুনিয়ার কাছে অন্তঃপুরবাসিনী ছিলেন। তবে সম্প্রতি এক গুরুত্বপূর্ণ চিনা কমিউনিস্ট নেতা বো জিলাইয়ের স্ত্রীকে নিয়ে পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমে হইচই হয়। কারণ তাঁর স্ত্রী এক ব্রিটিশ ব্যবসায়ীকে হত্যা করেছেন বলে অভিযোগ।
ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীকেও আমেরিকার প্রেসিডেন্টের স্ত্রীর মতো সক্রিয় দেখা যায়নি। কমলা নেহরু তো বেশি দিন বাঁচেননি। সুন্দরী সেই নারীর মৃত্যু হয় ১৯৩৬ সালে। তা ছাড়া, ভারতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে প্রধানমন্ত্রী, এমনকী রাষ্ট্রপতির স্ত্রী-ও অতিসক্রিয় ভূমিকায় কোনও দিন আসেননি। লালবাহাদুর শাস্ত্রী, মোরারজি দেশাই থেকে বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ, চন্দ্র শেখর কারও স্ত্রীকেই এই ভূমিকায় ভারত দেখেনি। রাজীব যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন সনিয়া তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর নানা প্রান্ত ঘুরেছেন। বলা যায়, তিনিই প্রথম দেশের প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী যিনি দৃশ্যমান ছিলেন। সনিয়াও কিন্তু কখনওই মার্কিন ফার্স্ট লেডির মতো আচরণ করেননি। কারণ ভারতের সংবিধান ও রীতিনীতিতে তা নেই। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের কন্যা শর্মিষ্ঠা নৃত্যশিল্পী হিসেবে নানা দেশে যেতে পারেন। বাবা রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগেও শর্মিষ্ঠা তা করতেন। কিন্তু এ দেশে রাষ্ট্রপতির স্ত্রীকে ক্যামেরায় বারবার দেখা গেলেও তাঁরা ফার্স্ট লেডি ছিলেন না।
চিনের ফার্স্ট লেডির বিষয়টি কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন। ডারবানে তাঁকে সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করলেন, আপনার সুন্দর ডিজাইনার পোশাক, কোট, জুতো এ সব নিশ্চয়ই প্রাডা বা টোড বা অন্য কোনও বিশেষ আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের? জবাবে ফার্স্ট লেডি একটি মোক্ষম কথা বলেন। তাঁর বক্তব্য, “জামা-কাপড় জুতো-ব্যাগ সবই স্বদেশি। চিনের একসেপশন নামের একটি ডিজাইনার সংস্থা থেকে কেনা।” এখন নাকি চিনের যুবক-যুবতীরা সবাই ওই ডিজাইনারের কাছে ছুটছেন। চিনা ফ্যাশনে ওটাই ‘ইন’।
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট ডিলমা লাউসেফ সে দেশের প্রথম মহিলা প্রেসিডেন্ট। ৬৬ বছরের এই মহিলা খুবই পোশাক সচেতন। তাঁর খুব পছন্দ হয়েছে চিনা প্রেসিডেন্টের ঘরণীকে।
ফার্স্ট লেডি পেং চিন সামরিক বাহিনীরও নাগরিক সদস্য। তিনি সামরিক পোশাক পরে নানা দেশে চিন লোকগীতি শোনাচ্ছেন। আর আজ তাঁর ব্যবহৃত পোশাক চিনের বাজারে নিলাম হচ্ছে। মজার ব্যাপার, ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে তিনি প্রচুর সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন দেশ বিদেশের নানা পত্রপত্রিকায়। কী ভাবে তিনি প্রেমে পড়েছিলেন। প্রথমে মনে হয়েছিল কেমন যেন বুড়ো বুড়ো লোকটা। পরে মনে হয়েছিল, তিনি খুব বুদ্ধিমান।
এ সব তো বুর্জোয়া রাষ্ট্রে হয়। এ কোন সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্র? এ এক নতুন সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি। মনমোহন সিংহের স্ত্রী গুরশরণ কৌরকে তাঁর লোকগীতির ডিভিডি-র সম্ভার উপহার দিয়েছেন। সীমান্ত বিবাদ নিয়ে দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পাশাপাশি এ বার শ্রীমতী পেং-ও কি তা হলে ভারতের সঙ্গে সংস্কৃতির নরম কূটনীতিক তাসটি ব্যবহার করবেন? |