মুখ্য সচিব চুক্তি মেনে জিটিএ চালানোর অনুরোধ জানিয়ে বিমল গুরুঙ্গকে চিঠি দিয়েছিলেন ২৭ ফেব্রুয়ারি। তার প্রায় এক মাসের মাথায় মঙ্গলবার সেই চিঠির জবাব দিতে গিয়ে রাজ্যের বিরুদ্ধে কার্যত চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ আনলেন গুরুঙ্গরা। জিটিএ-এর তরফে মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরি মুখ্য সচিবকে পাঠানো চিঠিতে লিখেছেন, ত্রিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী খুন ছাড়া অন্য অপরাধে অভিযুক্ত দলীয় সদস্যদের উপর থেকে চুক্তির দিন থেকে ১০ দিনের মধ্যে মামলা প্রত্যাহার করার শর্ত ছিল। মোর্চার অভিযোগ, রাজ্য সরকারই জিটিএ চুক্তি লঙ্ঘন করেছে। উল্লেখ করা হয়েছে যে, প্রায় সাড়ে ছ’শো মোর্চা সদস্যের নামের তালিকাও কয়েক মাস আগে রাজ্যকে দেওয়া হলেও কাজের কাজ হয়নি।
মোর্চার বক্তব্য, তাঁদের সেই দাবি মানা তো দূরের কথা, পাহাড়ে সিআরপি মোতায়েন করে পরিবেশ সন্ত্রস্ত করে রাখতে চাইছে রাজ্য। তাঁরা জানাচ্ছেন, পঞ্চায়েত নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনীর প্রস্তাব রাজ্য সরকার ফের প্রত্যাখান করেছে। কিন্তু পাহাড়ে প্রায় মাস খানেক ধরেই সিআরপি রয়েছে। মোর্চার সভাপতি বিমল গুরুঙ্গের দাবি, “রাজ্য সরকার আসলে দু’মুখো নীতি নিয়েছে। এটা তৃতীয় শ্রেণির রাজনীতি।”
তৃণমূলের অবশ্য পাল্টা দাবি, পাহাড়বাসীর কথাতেই সেখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেবের কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী পাহাড়ে গণতান্ত্রিক পরিবেশ চান। সে কারণেই পাহাড়বাসীর আর্জি মেনেই পদক্ষেপ করছেন।” পাহাড়ের ব্যবসায়ীদের একাংশও একই কথা বলেন। পর্যটন ব্যবসায়ী উরগেন শেরপা, সঞ্জয় মিত্রুকার মতো অনেকেই বলেন, “সম্প্রতি রাজ্য-মোর্চা সম্পর্কের অবনতির পরে পর্যটকেরা খুবই ভয়ে থাকেন। তাঁরা চান নিরাপদ পরিবেশ। সিআরপি থাকায় সেই পরিবেশটাই তাঁরা পাচ্ছেন। তবে বেশিদিন সিআরপি থাকা কি ভাল? তা হলে তো কাশ্মীরের সসঙ্গে তুলনা হবে দার্জিলিঙের।”
এই প্রসঙ্গে দার্জিলিং বার অ্যাসোসিয়েশনের সহ সভাপতি শেষমণি গুরুঙ্গ দাবি করেন, মোর্চা শান্তিপুর্ণ আন্দোলনই করছিল। তিনি বলেন, “মুখে সুইৎজারল্যান্ড গড়ার কথা বললেও আদতে সিআরপি নিয়োগ করে রাজ্যই দার্জিলিংকে অস্থির জায়গা হিসেবে দেশের সামনে তুলে ধরতে চাইছে।”
তবে মোর্চার তরফে নানা ভাবে চাপ তৈরি হলেও দার্জিলিং পাহাড় থেকে আপাতত সিআরপি সরানোর কোনও প্রশ্নই নেই বলে প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে। মোর্চার অন্দরের খবর, রাজ্য তো বটেই, সম্প্রতি একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও গ্রীষ্মের পর্যটন মরসুমের আগে পাহাড় থেকে সিআরপি সরানোর কথা ভাবা হচ্ছে না বলে একাধিক সরকারি কর্তা জানিয়ে দিয়েছেন। সে কথা বুঝেই এই পরিস্থিতিতেও সুর নরমই করে রেখেছে মোর্চা। মোর্চার সাধারণ সম্পাদক রোশন গিরির কথায়, “আমরা যেমন গোর্খাল্যান্ডের দাবি থেকে সরিনি। তেমনই জিটিএ যতদিন চালানো হবে, ততদিন দায়িত্ব পালন করতেও পিছ পা হব না। আবার জবরদস্তি সিআরপি মোতায়েন করে বিভাজনের রাজনীতি কায়েম করার শান্তিপূর্ণ বিরোধিতাও চালিয়ে যাব। যাতে সকলে বোঝেন, মোর্চা কখনও অশান্তির রাস্তায় হাঁটতে চায় না।”
এই পরিস্থিতিতে মোর্চার সঙ্গে কংগ্রেসের নৈকট্য আরও বাড়ছে। ৭ ও ৮ এপ্রিল মোর্চার অনুরোধেই কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ আসছেন দার্জিলিংয়ে। গুরুঙ্গদের প্রস্তাব মেনে তখন তিনি পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য একগুচ্ছ প্রস্তাবও ঘোষণা করতে পারেন। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এই দিন বলেন, “দার্জিলিংয়ে ২৩০ কিলোমিটার গ্রামীণ সড়ক নির্মাণের প্রস্তাব রয়েছে। অতিরিক্ত ৯৭ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণের কথাও ঘোষণা করা হবে।” দারিদ্রসীমার নীচে বসবাসকারীদের জন্য গৃহনির্মাণ প্রকল্পও ঘোষণা করা হতে পারে। সেক্ষেত্রে মোর্চা-কংগ্রেসের এই সম্পর্ক রাজ্যের সঙ্গে গুরুঙ্গদের সম্পর্ককে কোন দিকে ঠেলে দেবে, তার দিকে নজর রাখছে পাহাড়বাসী।
মোর্চা ও কংগ্রেসের এই নৈকট্যই এখন পাহাড়ে রাজনীতির নতুন সমীকরণের সম্ভাবনা নিয়েও প্রশ্ন তুলে দিচ্ছে। বস্তুত গুরুঙ্গের সাম্প্রতিক দিল্লি সফরের অনুঘটক ছিলেন রায়গঞ্জের কংগ্রেস সাংসদ ও কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সি। অতীতে গোর্খাল্যান্ডের দাবিকে সফল করতে গুরুঙ্গরা বিজেপি-র যশোবন্ত সিংহকে সমর্থন দিয়েছিলেন। তারপরে আবার বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের সঙ্গে মোর্চার সখ্য গড়ে উঠেছিল। সেই প্রেক্ষিতে সাম্প্রতিক এই পরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করা হচ্ছে।
যদিও নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে জয়রাম তা এড়িয়ে যেতে চান। বলেন, “দার্জিলিংয়ের অনুন্নয়নের সমস্যার সমাধানে গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক কতটা সহযোগিতা করতে পারে, সে ব্যাপারেই আমি চিন্তিত। এর সঙ্গে রাজনীতি মিশিয়ে ফেলা ঠিক হবে না।”
তবে কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব স্বীকার করছেন, রাজনৈতিক ভাবে গুরুঙ্গদের সঙ্গে সমঝোতার একটা প্রয়াস চলছে। মোর্চা নেতারাও বুঝতে পারছেন, যশোবন্ত সিংহকে দার্জিলিং থেকে প্রার্থী করে তাঁদের আখেরে কোনও রাজনৈতিক সুবিধাই হয়নি। তৃণমূলের প্রতিও তাঁদের মোহভঙ্গ হয়েছে। এই অবস্থায় লোকসভা ভোটের আগে মোর্চার সঙ্গে কংগ্রেসের একটি আনুষ্ঠানিক সমঝোতার ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে শুরু করেছে। সেক্ষেত্রে এও হতে পারে যে, লোকসভা ভোটে দার্জিলিংয়ে কংগ্রেসের প্রার্থীকেই সমর্থন জানাবে মোর্চা। |