রবার্তো বাজ্জো আর ওকোলি ওডাফার মধ্যে কী আশ্চর্য মিল!
চুরানব্বইয়ের সেই বিশ্বকাপ ফাইনালের পেনাল্টি কিক বিশ্ব ফুটবলের ব্যর্থতার মাইলস্টোন হয়ে আছে এখনও। পোস্টের উপর দিয়ে যা উড়িয়ে ব্রাজিলকে কাপ তুলে দিয়ে খলনায়ক হয়ে গিয়েছিলেন ইতালির স্ট্রাইকার বাজ্জো।
রবিবারের যুবভারতীতে অনেকটা সে রকমই যেন হয়ে গেলেন ওডাফা। আইএফএ শিল্ড সেমিফাইনালের জয়-পরাজয়ের কাঁটা যখন পেন্ডুলামের মতো দুলছে, আশি হাজার দর্শকের হৃদস্পন্দন পরিণত হয়েছে স্তব্ধতায়। তখনই ওডাফার টাইব্রেকারের প্রথম কিক ডান দিকে ঝাঁপিয়ে আটকে দিলেন ইস্টবেঙ্গল গোলকিপার গুরপ্রীত সিংহ। মাঠের যে কোনও জায়গা থেকে গোল করা যাঁর কাছে জলভাত, এ দেশে এসে দু’শোর উপর গোল করেছেন যিনি, সেই গোলমেশিন ব্যর্থ! বিস্ময়ের এই শক্তিশেলেই শেষ হয়ে গেল মোহনবাগান। ইস্টবেঙ্গলকে বুধবারের ফাইনালে প্রয়াগ ইউনাইটেডের সামনে এনে ফেলল। গত বারের ফটোকপি হয়ে।
বাজ্জো-র পেনাল্টি কিক নষ্টের পর কাগজে হেডিং হয়েছিল, “বিশ্বের সব সেরা ফুটবলারই তা হলে পেনাল্টি নষ্ট করতে পারে!” মোহনবাগান টিম যখন স্টেডিয়াম ছাড়ছে, তখনও কাঁদছিলেন বহু সবুজ-মেরুন সমর্থক। হতাশায়, যন্ত্রণায়। আই লিগ অবনমনের আতঙ্কের মধ্যেও অক্সিজেন খুঁজতে এসেছিলেন ওঁরা। তাঁদের মুখগুলো যেন বলতে চাইছিল, “ওডাফা তুমিও তা হলে পেনাল্টি নষ্ট করতে পার!”
অষ্টআশি বছরের বাঙালির চিরকালীন ডার্বি বহু নায়কের জন্ম দিয়েছে। ফকিরও করে ছেড়েছে অনেককে।
এ দিনের ডার্বিও নায়ক করে দিল ইস্টবেঙ্গলের অস্ট্রেলীয় স্ট্রাইকার অ্যান্ডু বরিসিচকে। আর আকাশ থেকে মাটিতে আছড়ে ফেলল মোহনবাগানের গোলমেশিন ওডাফাকে।
খেলা শেষ হওয়ার তিন মিনিট আগে বরিসিচ দেবদূত হয়ে দেখা দিলেন ট্রেভর মর্গ্যানের টিমে। তাঁর বিশ্বমানের রামধনু শট মুখের গ্রাস কেড়ে নিল মোহনবাগানের। আর একটা পেনাল্টি কিক খলনায়ক করে দিয়ে গেল ওডাফাকে। |
জয়ের দুই নায়ক
গুরপ্রীতের কাঁধে বরিসিচ। ছবি: শঙ্কর নাগ দাস |
ম্যাচ শেষ হওয়ার পর আদুর গায়ের উচ্ছ্বসিত বরিসিচকে দেখছিলেন টোলগে। গ্যালারির দিকে নিজের সাতাশ নম্বর জার্সিটা ছুঁড়ে দিয়ে আসার পর ফর্সা শরীর লাল-হলুদ আবিরে মাখামাখি। পিছনে পাগলের মতো ছুটছে জনতা। গত দু’বছর এ রকম কত বার হয়েছে তো টোলগের জীবনেও। জার্সি বদলে এখন তিনি অন্য দলে। আজ তাঁর উদাস দৃষ্টি দেখে মনে হল, পথ হারানো কোনও পথিক!
ম্যাচের পর লাল-হলুদের সাহেব কোচ গটগট করে যখন ড্রেসিংরুমে দিকে যাচ্ছেন, তখন তাঁর চোখ দুটো যেন জ্বলছিল। গ্যালারির কাগজের তৈরি মশালের আগুনের সঙ্গে যার তুলনা করা যেতেই পারত। টোলগের দিকে এক বার শ্যেন দৃষ্টি নিয়ে এমন ভাবে তাকালেন মর্গ্যান, মনে হল ভষ্ম করে দেবেন! অ্যান্ডু বরিসিচের মতো টোলগেকেও তো ভারতে এনেছিলেন সাহেব কোচ। সেই যন্ত্রণার বহিঃপ্রকাশ হয়তো এই তাকানো। ম্যাচের পর বলেও গেলেন, “বরিসিচ যে গোলটা করেছে, এই গোল বিশ্বের যে কোনও ম্যাচ জেতাতে পারে। আশা করব, ও এ রকম গোল আরও করবে।” তাঁকে প্রশ্ন করা হল না, পুরনো ছাত্র টোলগের জন্য কোনও পরামর্শ আছে কি না?
বিশ্ব ফুটবলে বড় কোচ হওয়ার অন্যতম শর্ত হল, রিজার্ভ বেঞ্চের সঠিক ব্যবহারের দক্ষতা। এ দিনের ডার্বিতে সেই দক্ষতা দেখিয়েই করিম বেঞ্চারিফাকে পিছনে ফেলে দিলেন মর্গ্যান। মোহন-কোচকে পাঠিয়ে দিলেন রিংয়ের বাইরে।
বিপক্ষের ট্যাকটিক্স দেখে নিয়ে বিরতিতে পাল্টা স্ট্র্যাটেজি তৈরি করে টিমকে মাঠে নামানোই করিমের সেরা অস্ত্র। এই অস্ত্র ব্যবহার করে বহু বার সফল হয়েছেন মরক্কান। এ দিনও প্রথমার্ধ গোলশূন্য থাকার পর খেলা শুরু হতেই সেই অঙ্কেই মোহনবাগান এগিয়ে গেল। নির্মলের ক্রস বুক দিয়ে নামিয়ে ওডাফা টোকা মেরে তুলে দিয়েছিলেন ইস্টবেঙ্গল বক্সে। চলতি বলেই সাবিথের গোল। বিরতির এক মিনিটের মধ্যে গোল এবং তার পরের পনেরো মিনিট ছাড়া মোহনবাগান কখনও ম্যাচের রাশ নিতে পারেনি। বরং বলা যায় লালরিন্দিকা, চিডিরা গোল করে ফেললে প্রথমার্ধেই গ্যালারির আকাশে লাল-হলুদ আবির উড়তে পারত। নাচানাচি শুরু হতে পারত ইলিশ নিয়ে। |
টাইব্রেকারে শেষ চার ডার্বি |
১২ ম্যাচ টাইব্রেকারে |
ইস্টবেঙ্গল ৬
মোহনবাগান ৬ |
২০১০ প্লাটিনাম জুবিলি কাপ ফাইনাল |
ইস্টবেঙ্গল ৬ : মোহনবাগান ৫ |
২০০৮ ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনাল |
ইস্টবেঙ্গল ৩ : মোহনবাগান ৫ |
২০০৪ আইএফএ শিল্ড সেমিফাইনাল |
ইস্টবেঙ্গল ৭ : মোহনবাগান ৮ |
২০০৩ আইএফএ শিল্ড ফাইনাল |
ইস্টবেঙ্গল ৩ : মোহনবাগান ৫ |
|
কিন্তু যা হয়নি, তা নিয়ে কখনও মাথা ঘামান না মর্গ্যান। ০-১ পিছিয়ে যাওয়ার পরও। পকেট থেকে সেই বিখ্যাত কাগজের টুকরো বের করে টিম বদলাতে শুরু করলেন তিনি। হলেন সাহসীও। চলে গেলেন চূড়ান্ত আক্রমণে। ৪-৩-৩ এ। বরিসিচ এলেন পেনের জায়গায়। বলজিৎ এলেন রবিনের পরিবর্তে। স্কোরলাইনটা দেখুন। বরিসিচের নামের পাশে দু’দুটো গোল। একটা সমতায় ফেরানোর। অন্যটা পেনাল্টি কিকে। টাইব্রেকারের জয়ের শেষ শটটা এক পঞ্জাব তনয়ের বলজিৎ সিংহ। জয়ের সোনালি রেখাটা দেখিয়েছিলেন যিনি সেই গুরপ্রীত সিংহও পঞ্জাবেরই ছেলে। গত বারও ইস্টবেঙ্গলকে শিল্ড চ্যাম্পিয়ন করেছিলেন টাইব্রেকার আটকেই। এ দিন ফাইনালে তুললেন। ওডাফার শুরুর কিক তিনি না আটকালে ম্যাচটা কোথায় গিয়ে দাঁড়াত কে জানে!
প্রথমার্ধটা সতর্কতার মোড়কে থাকতে চেয়েছিলেন দুই কোচই। ম্যাচের আগের এক পশলা বৃষ্টি কৃত্রিম টার্ফকে অনেকটাই পিচ্ছিল করে দিয়েছিল। ফলে ওডাফা-পেনরা মাটিতে পা রাখতে গিয়ে পিছলে পড়ে গিয়েছেন। বল অন্য রকম স্পিন খেয়েছে, মাটিতে পড়ে গতি বাড়িয়েছে। ফলে মিস পাস হয়েছে প্রচুর।
ফাইনালে যেতে গেলে জিততেই হবে। তবুও ধুরন্ধর মর্গ্যান বা চতুর করিম নিজের তৈরি অঙ্কতেই মেতে থেকেছেন। পেন বল ধরলেই ডেনসন বা কুইনটন তেড়ে আসছিলেন। আবার ওডাফার পায়ে বল পড়লেই ছেঁকে ধরছিলেন ওপারা-মেহতাবরা। চিডির গায়ে লেপ্টে ছিলেন ইচে। মেহতাব বল পেলেই তাড়া করছিলেন জুয়েল। ট্যাকটিক্সের এই ঝনঝনানির আবহে বিরতির আগে পর্যন্ত মনে হচ্ছিল ম্যাচটা শুধুই বিরক্তি উৎপাদন করবে।
কিন্তু বিরতির পর যে পরতে পরতে এত উত্তেজনার লাভা বেরোবে, কে জানত। ১২০ মিনিটের লড়াই ১-১ হয়ে শেষ। এর পর টাইব্রেকার। চমকপ্রদ মিস, দুর্দান্ত সেভ। নায়ক-খলনায়কের উত্থান-পতন। ফুটবল-রসনার তৃপ্তির জন্য আর কী চাই!
অকাল ডার্বিও তা হলে হিট!
ইস্টবেঙ্গল: গুরপ্রীত, হরমনজিৎ, উগা, গুরবিন্দর, সৌমিক, সঞ্জু, পেন (বরিসিচ), মেহতাব, লালরিন্দিকা (নওবা), চিডি, রবিন (বলজিৎ)
মোহনবাগান: শিল্টন, নির্মল, ইচে, মেহরাজ, আইবর, জুয়েল, কুইনটন (টোলগে), মণীশ মৈথানি, ডেনসন (বিশ্বজিৎ) ওডাফা, সাবিথ |