|
|
|
|
মোদীর পথে কাঁটা ছড়িয়ে কংগ্রেসকে বার্তা নীতীশের
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার দৌড় থেকে নরেন্দ্র মোদীকে রুখতে এ বার রাজধানীর বুকে তৎপর হলেন নীতীশ কুমার। যার ফলে লোকসভা নির্বাচনের আগে মোদী বনাম নীতীশ লড়াইটা চলে এল দিল্লির প্রাণকেন্দ্রে।
দিল্লির রামলীলা ময়দানে নীতীশের এ দিনের বিশাল জনসভার লক্ষ্য অবশ্য ছিল বিহারের বিশেষ মর্যাদার দাবি। স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর মূল নিশানা হওয়ার কথা ছিল কেন্দ্রের মনমোহন সিংহ সরকার। কিন্তু এ দিন ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে একটি বাক্যও খরচ করলেন না নীতীশ! কংগ্রেসের প্রতি আক্রমণের ঝাঁঝটিও ছিল উধাও। উল্টে দেশের অন্য অংশের তুলনায় বিহারের পিছিয়ে থাকার বিষয়টি স্বীকার করে নেওয়া এবং পিছিয়ে পড়া এলাকার মাপকাঠিতে পরিবর্তনের যে সিদ্ধান্ত চিদম্বরম বাজেটে ঘোষণা করেছেন, তার তারিফ করে অস্বস্তি বাড়ালেন বিজেপিরই। জানিয়ে দিলেন, লোকসভার পর সরকার গড়ার চাবিকাঠি থাকবে তাঁর হাতেই। আর বোঝালেন, বিজেপির একাংশ মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে দেখতে চাইলেও এনডিএ-র সর্বসম্মত তথা ধর্মনিরপেক্ষ প্রার্থী হিসেবে তাঁরও দাবি নেহাত কম নয়। ফলে বিহারে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর দিল্লিতে প্রথম জনসভায় নীতীশ আসলে বিজেপির নেতা বাছাইয়ের কাজটি আরও জটিল করে তুললেন। শুধু তা-ই নয়, রাজধানীর বুকে শক্তি প্রদর্শন করে আসলে মোদীর উদ্দেশেই কঠিন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন এনডিএ-র বৃহত্তম শরিক দলের মুখ্যমন্ত্রী। |
রামলীলা ময়দানের সভায় নীতীশ। রবিবার। ছবি: পিটিআই |
গোধরা পরবর্তী সময় থেকেই নীতীশ গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধিতা করে আসছেন। মূলত তাঁরই আপত্তিতে বিহারের বিজেপি নেতারা চাইলেও গত বিধানসভা নির্বাচনে ওই রাজ্যে প্রচারে যেতে পারেননি মোদী। এমনকী সম্প্রতি মোদী-ঘনিষ্ঠ বিহার বিজেপি সভাপতি সি পি ঠাকুরের পুনর্নিবাচনেও আপত্তি জানান নীতীশ। মূলত তাঁর ও রাজ্যের উপমুখ্যমন্ত্রী তথা বিজেপি নেতা সুশীল মোদীর দাবি মেনে মঙ্গল পাণ্ডেকে বিহারের বিজেপি সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করে দল। প্রসঙ্গত, রাজ্য রাজনীতিতে মঙ্গল নীতীশ ঘনিষ্ঠ। বিহারের মুখ্যমন্ত্রীকে অস্বস্তিতে রাখতে মোদীকে বিহারে নিয়ে গিয়ে একাধিক সভা করার পরিকল্পনা করেছিলেন সি পি ঠাকুর। পাণ্ডে দায়িত্ব পেয়েই তা বাতিল করে দেন। আর আজ নীতীশ বোঝালেন, মোদীর প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হওয়ার পরিকল্পনায় বড় বাধা তিনি।
সোমবারই মনমোহন সিংহ ও চিদম্বরমের সঙ্গে বৈঠকে বসতে পারেন নীতীশ। তার আগে আজ মোদীর নাম না করেই প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে নীতীশ বলেন, মুষ্টিমেয় কিছু উন্নত রাজ্যের উপর প্রধানমন্ত্রীর অতিনির্ভরশীলতা দেশের ক্ষতি করছে। বরং বিহারের মতো রাজ্যগুলিকে সাহায্য করা দরকার কেন্দ্রের। যাতে তারাও দেশের উন্নয়নে শরিক হতে পারে। মোদী গুজরাতের উন্নয়নের পিছনে তাঁর বিকাশ মডেলের কথা বারবার তুলে ধরেন। এ দিন পরোক্ষে তারও সমালোচনা করে নীতীশের ব্যাখ্যা, ওই ধাঁচে এগোলে কিছু লোকের উন্নতি হতে পারে। কিন্তু সমাজের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিজেপির যে অংশটি ‘বিকাশ পুরুষ’ মোদীকে প্রধানমন্ত্রী পদে দেখতে চায়, এ দিন পরোক্ষে তাদেরও বার্তা দেন নীতীশ।
গত কালই দিল্লিতে একটি অনুষ্ঠানে এসে মোদী বিহারের নাম না করেও কোনও রাজ্যকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়ার ব্যাপারে তাঁর আপত্তির কথা হাবেভাবে জানিয়েছিলেন। কিন্তু তার পরেও নীতীশকে বার্তা দিতেই মোদী মহারাষ্ট্রে তাঁর এ দিনের সভা বাতিল করেছেন। আজ যখন নীতীশ নাম না করেই তাঁর উন্নয়নের মডেলকে কটাক্ষ করলেন, তখন মোদীই বা কী করে চুপ থাকতে পারেন? নীতীশের সভার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই মোদী সরকার এক বিবৃতি জারি করে। যার বক্তব্য, গুজরাতে মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ নয়, সকলেরই উন্নয়ন হয়েছে। এই মডেলই গোটা দেশে অনুকরণ করা উচিত।
মোদীকে ঠেকাতে নীতীশের এই উদ্যোগে বিজেপির শীর্ষ নেতারা যে অস্বস্তিতে, তা নয়। বরং বিজেপির মধ্যে মোদী-বিরোধীরা অনেকেই খুশি। বিজেপির আশঙ্কা অন্যত্র। আজকের পর লোকসভা ভোটের আগে এনডিএ-র নেতা কে হবেন, তা আরও জটিল হয়ে পড়ল। মোদী বিজেপিতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছেন। অন্য দিকে রাজ্যের বিশেষ মর্যাদার দাবি তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীন পট্টনায়কের মতো আঞ্চলিক নেতাদের একজোট করার চেষ্টা চালাচ্ছেন নীতীশ। অথচ এই আঞ্চলিক নেতাদেরই এনডিএ-তে সামিল করার স্বপ্ন দেখছেন বিজেপি নেতৃত্ব।
বিজেপির অন্য একটি আশঙ্কাও রয়েছে। এনডিএ-র শরিক হলেও এ দিনের সমাবেশে বিজেপি নেতৃত্বকে আমন্ত্রণ জানাননি নীতীশ। কিন্তু কংগ্রেসের প্রতি যে নরম মনোভাব নীতীশ দেখিয়েছেন, তা দেখে অনেকেই মনে করছেন, জেডিইউ এই মুহূর্তে এনডিএ শিবিরে থাকলেও বিহারকে বিশেষ মর্যাদা দিলে শিবির বদলাতে দ্বিধা করবেন না। তা ছাড়া জেডিইউ-র রাজ্যসভা সাংসদ এন কে সিংহ দীর্ঘ দিন ধরেই কংগ্রেসের সঙ্গে সুসম্পর্কের রেখে চলেছেন। ভোটের আগে বিহারের জন্য আর্থিক প্যাকেজ না হলেও একটি মধ্যপন্থা বার করে বাড়তি অর্থ নীতীশ আদায় করে নিতে পারেন বলে মনে করছেন বিজেপির একাংশ। তাঁদের ধারণা, ঘুরপথে বিহারে জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে নীতীশকে কাছে টানার কৌশল নিয়ে ভাবছে কংগ্রেসেও। নীতীশও এ দিন বলেন, “যারা পিছিয়ে পড়া বিহারের সমস্যার সমাধানে ঐকান্তিক হবে, তারাই আগামী দিনে দিল্লির সিংহাসন দখল করবে। সময়ে ওই সাহায্য না পেলে মানুষ তাদের সঙ্গেই থাকবেন, যাঁরা আমাদের ন্যায় দেবেন।”
আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে নীতীশ ও তাঁর দল যে ‘কালো ঘোড়া’ হতে চলেছেন, তা নিয়ে দ্বিমত নেই অনেকেরই। বিহারে ৪০টি লোকসভা আসনের মধ্যে বর্তমানে ২০টি আসন জেডিইউ-র দখলে। গত চার বছরে ওই রাজ্যে বিরোধী লালুপ্রসাদ ও রামবিলাসের শক্তি ক্রমশ কমেছে। জেডিইউ শিবিরের দাবি, আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে তিরিশ বা তার বেশি আসন পাবে তারা। সেই পরিস্থিতিতে সরকার গড়ার চাবি যে মূলত তাদের হাতেই থাকবে, তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন নীতীশরা। সেই ভরসাতেই আজ ইউপিএ ও এনডিএ এই দুই শিবিরকেই বার্তা দিতে রামলীলা ময়দানের সমাবেশকেই বেছে নিয়েছিলেন নীতীশ। এ দেশের আঞ্চলিক দলগুলি যখনই জাতীয় স্তরে নিজেদের শক্তি প্রদর্শন করতে চায়, তখন বরাবরই তারা রামলীলা ময়দানকে বেছে নিয়েছেন। এ দিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। |
|
|
|
|
|