|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
খেলা দিয়েই ছুঁতে চেয়েছেন জীবনের নানা সংকট |
আকৃতি গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল পার্থপ্রতিম দেবের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
পুরোনো দিনের একটা লণ্ঠন। চিমনিটি খোলা রয়েছে। বা নামানো রয়েছে। যেখানে শিখা জ্বলে আলো বিকিরণ করে, সেইখানে চিত করে শায়িত রাখা রয়েছে মৃত এক নগ্নিকা নারীকে। লণ্ঠনটি প্রকৃত লণ্ঠন। তেল ও এনামেল পেন্ট দিয়ে রং করে তার উপর হলুদ বুনোট তৈরি করা হয়েছে। মৃতা মানবীর অবয়বটি পেপার পাল্প ও কাঠের গুঁড়ো দিয়ে নির্মিত। যেখান থেকে শিখা জেগে ওঠে এই আলোকবর্তিকার, সেখানেই পড়ে আছে এই ধর্ষিতা নিহত রমণী। একটি পরিত্যক্ত ব্যবহারযোগ্য বস্তু, যাকে ফাউন্ড অবজেক্ট বা ‘রেডিমেড’ বলা যায়, তার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে একটি নির্মিত ভাস্কর্য। এই দুইয়ের সমন্বয় সহসা ধাক্কা দেয় আমাদের চেতনায়। দিল্লি ধর্ষণের বীভৎস ঘটনায় আজ যখন আলোড়িত সারা দেশ তখন এই অভিনব রূপকল্প এক করুণ বার্তা বয়ে আনে।
এখনকার গতানুগতিক ছবি ভাস্কর্যের বাইরে এটি একটি ব্যতিক্রমী রচনা। এর স্রষ্টা বিশিষ্ট শিল্পী পার্থপ্রতিম দেব। আকৃতি গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর এ ধরনের অজস্র পরিত্যক্ত বস্তু থেকে নির্মিত কাজ নিয়ে প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘প্লে ফর জয় অব সিয়িং’। দেখার আনন্দ নিয়ে খেলা। পার্থপ্রতিমের এই প্রথাবিরোধী সৃজনগুলির মধ্যে সেই খেলার আনন্দ আছে ঠিকই। কিন্তু সেই নিরুদ্দেশ আনন্দকে ছাপিয়ে অন্য এক বার্তাও ধ্বনিত হয়েছে। |
শিল্পী: পার্থপ্রতিম দেব |
আপাত ভাবে এটি একটি নির্দোষ ঝুলন্ত টি-শার্ট। কাঠের হ্যাঙ্গারে ঝুলছে। টি-শার্ট এবং হ্যাঙ্গার দু’টোই প্রকৃত এবং পরিত্যক্ত। সেই শার্টটির ভিতরে পেপার পাল্পের প্রলেপ দিয়ে তাকে বেশ শক্ত বা টানটান করা হয়েছে। তার উপর শিল্পী সেঁটেছেন ছাপা কাগজ। খবরের কাগজের টুকরো অংশ। তাতে নানা রকম অর্থপূর্ণ অক্ষরমালার বিন্যাস দেখা যাচ্ছে। যেমন ‘এ সাইন অব টাইমস’, ‘টেলিফোন রিভলিউশন’, ‘কনফেশনস অব এ গেটকিপার’ ইত্যাদি। এই শব্দগুলির মধ্যে কিছু অর্থের দ্যোতনা আছে, যা এই সময়ের বিশেষ চরিত্রের নানা দিকের আভাস আনে। এর পর ওই সাঁটা কাগজের উপর শিল্পী রেখায় ছবি এঁকেছেন। চলমান জীবনের নানা প্রতিমাকল্প ছড়িয়ে দিয়েছেন যেন একটি যুবকের শরীর জুড়ে। বস্তু নিয়ে, কাগজ নিয়ে, রং-তুলি-কালি-কলম নিয়ে খেলতে খেলতে এই যে জীবন ও সময়ের ভিতর ঢুকে পড়া, কৌতুক থেকে শুরু করে করুণ শূন্যতার আভাস নিয়ে আসা, এটাই এই রচনাগুলির বৈশিষ্ট্য। এটা করতে গিয়ে শিল্পী বিকল্প রূপকল্প বা অলটারনেটিভ আর্টের নানা সম্ভাবনা নিয়ে যে ভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, তার স্বকীয়তা অসামান্য।
১৯১৭ সালে মার্সাল দ্যুসা যখন একটি পরিত্যক্ত মূত্রাধারকে শিল্পকর্ম বলে উপস্থাপিত করেছিলেন, তখন তার মধ্যে ছিল এক ধরনের প্রতিবাদী চেতনা। ১৯৪২ সালে পিকাসো সাইকেলের সিট ও হ্যান্ডেল জুড়ে তৈরি করেছিলেন বৃষমুণ্ড। ১৯৩২-৩৩-এ অবনীন্দ্রনাথ ‘খুদ্দুর যাত্রা’র লেখাকে কাগজ থেকে কাটা ছবি সেঁটে সাজিয়েছিলেন। খেলার ভিতর দিয়ে সেখানে প্রকাশ পেয়েছিল সমাজ-পরিস্থিতির বিরুদ্ধে তির্যক শ্লেষ। ১৯৬০-এর দশকে বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায় কাগজ, কাপড়, চামড়া ইত্যাদি সেঁটে তৈরি করছিলেন ছবি। খেলা থেকে উৎসারিত হচ্ছিল সৌন্দর্যের নতুন দিগন্ত। এই পরম্পরারই আজকের প্রতিনিধি পার্থপ্রতিম। খেলা দিয়েই তার রচনাগুলির শুরু। কিন্তু নিছক খেলাতেই তা শেষ নয়। খেলার ভিতর দিয়েই তিনি ছুঁয়েছেন জীবনের নানা সংকটকে।
শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী কলাভবনের ছাত্র ছিলেন পার্থপ্রতিম। নন্দলাল-বিনোদবিহারী-রামকিঙ্কর-কে.জি.সুব্রামনিয়নের সৃজনের উত্তরাধিকারকে নিজের মতো করে প্রসারিত করেছেন। রবীন্দ্রভারতীর দৃশ্যকলা অনুশিষ্য প্রধান ছিলেন দীর্ঘ দিন। সেখানে বসে এ ধরনের কাজ করা ছিল তাঁর শিক্ষকতারই অঙ্গ। সংস্কারের গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করেছেন অনেক ছাত্রকে। আলোচ্য প্রদর্শনীর কাজগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য কল্পরূপ বা ফ্যানটাসি। এই ফ্যানটাসির আবহ তাঁর ছবিতেও থাকে। খেলাচ্ছলে গড়ে তোলা কৌতুকের আবহ থেকেই জেগে ওঠে সূক্ষ্ম এক ট্র্যাজিক চেতনা। কখনও কখনও বিশুদ্ধ সৌন্দর্যের এক ভিন্ন মাত্রাও তুলে আনেন। কেরোসিন স্টোভের উপর হাঁড়ি। হাঁড়ির মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছে অজস্র দড়ি। ফুটে আছে দড়ির ফুল। দেখার বিপুল বিস্তারই তাঁর শিল্পীসত্তার বৈশিষ্ট্য। |
|
|
|
|
|