চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১...
সামাজিক ও পারিবারিক বাধা অতিক্রম করা এক মানবী
দানীং কালে দিল্লি নিবাসী শিল্পী মিমি রাধাকৃষ্ণানের ছবি কলকাতায় আমরা খুব বেশি দেখিনি। তাঁর জন্ম কলকাতায় ১৯৫৫ সালে। গত প্রায় বছর তিরিশেক তিনি দিল্লিতেই রয়েছেন। স্নাতকস্তরে তাঁর শিল্পশিক্ষা বিশ্বভারতীর কলাভবনে। সোমনাথ হোরের কাছে ছাপচিত্র শিখেছেন। স্নাতকোত্তর স্তরে বরোদায় শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলেন কে.জি. সুব্রামনিয়নকে। তার পর নিরন্তর কাজ করে ছবিতে নিজস্ব এক প্রকাশভঙ্গি তিনি তৈরি করেছেন। শান্তিনিকেতনের ঐতিহ্যের দূরতর স্পন্দন অনুভব করা যায় তাঁর ছবিতে। তবে সোমনাথ হোরের দৃশ্যতার জগৎ থেকে তা অনেকটাই দূরবর্তী। তাঁর ছবিতে রয়েছে ব্যক্তি, চারপাশের প্রকৃতি ও বিশ্বের এক অসামান্য প্রেমসম্পৃক্ত একাত্মতা। সেখানে শুধু শান্তিনিকেতন নয়, বাংলার সামগ্রিক লৌকিক জীবনের অনুরণন যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে বিনোদবিহারী ও সুব্রামনিয়নের সর্বাত্মবাদী দর্শনের স্নিগ্ধ প্রতিফলনও। এই বিপর্যস্ত সময়ে এক সদর্থকতার বার্তা তিনি তুলে আনেন তাঁর ছবিতে। কিন্তু সেই সদর্থকতাও প্রতিবাদী চেতনাতেই সঞ্জীবিত।
আকার প্রকার গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল তাঁর একক প্রদর্শনী। প্রদর্শনীটি অনুষ্ঠিত হয়েছে তাঁর লেখা একটি বই প্রকাশ উপলক্ষে। ছবিগুলি সেই বইয়েরই অলঙ্করণের উদ্দেশ্যে আঁকা। কিন্তু প্রতিটিই অসামান্য চিত্রগুণে সম্পৃক্ত সম্পূর্ণ ছবি। নিছক সচিত্রকরণমূলক নয় কোনও ভাবেই। বরং বলা যায় এখানে চিত্র ও অলঙ্করণকে অত্যন্ত প্রজ্ঞাদীপ্ত ভাবে মিলিয়েছেন কবি।
শিল্পী: মিমি রাধাকৃষ্ণান
মিমি বাংলাভাষার একজন প্রতিষ্ঠিত লেখকও। যে বইয়ের জন্য এই ছবিগুলো, তার নাম ‘লবঙ্গলতিকা চরিত’। রূপকথাধর্মী একটি আখ্যানমূলক লেখা এটি। অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও স্নিগ্ধ ভাষায় এক মানবীর জীবন কাহিনি বর্ণিত হয়েছে এখানে। লেখার গুণে এটি হয়ে উঠেছে সমগ্র নারীজাতির আত্মার কথা।
চারপাশের সামাজিক ও পারিবারিক বাধাবন্ধন অতিক্রম করে একক মানবীর আত্মউন্মোচনের কথা। এই বাংলারই কোনও এক মধ্যবিত্ত পরিবারের এই মেয়েটির নাম লবঙ্গলতিকা। শৈশব থেকেই চার পাশের প্রকৃতি, পশুপাখির সঙ্গে তার একাত্মতা। এই পরিব্যাপ্ত ভালবাসা ও মুগ্ধতার মধ্য দিয়ে সে বড় হতে থাকে। একদিন তার বিয়ে হয়ে যায়। শ্বশুরবাড়ি গিয়ে জীবনের জটিলতার মুখোমুখি হয় সে। প্রতিবাদে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে। তখন প্রকৃতি তার দিকে সহানুভূতির হাত বাড়ায়। ত্রিকালজ্ঞ কালিবউস মাছ দেয় জাদু চাকতি। ব্যাঙ্গমা দম্পতি দেয় নানা সুপরামর্শ। মেয়েটি হয়ে ওঠে একজন লেখক। আত্মজীবনী লেখে সে। সেই বই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও সম্মানে ভূষিত। লবঙ্গলতিকা সব বাধা অতিক্রম করে জীবনকে জয় করে।
এই গল্পের ভিত্তিতেই শিল্পী এঁকেছেন আটটি ছবি। ছবির ভিতর রয়েছে রূপকথার আলোকিত পরিমণ্ডল। রয়েছে প্রকৃতির সঙ্গে সেই মানবীর একাত্মতার পরিচয়। আঙ্গিকের দিক থেকে বাস্তব ও কল্পরূপের সুষম সমন্বয় ঘটেছে। স্বাভাবিকতার মধ্যেই এসেছে সামান্য প্রতিচ্ছায়াবাদী রূপান্তরণ। ভারতীয় ধ্রুপদী চিত্রের আলোকময়তা, মধ্যযুগীয় অণুচিত্রের উদ্ভাসিত বর্ণপ্রয়োগরীতি, লৌকিকের সারল্য ও সুষমা এ সমস্তকে মিলিয়ে শিল্পী গড়ে তুলেছেন তাঁর নিজস্ব আঙ্গিক। পরম্পরাকে প্রসারিত করেছেন বিশ্বগত ব্যাপ্তিতে।
প্রথম ছবিটিতে দেখি তেরো বছরের কিশোরী লবঙ্গলতিকা বসে আছে বাড়ির বাগানে। সঙ্গে তার পোষা দু’টি ছাগল ইন্তি ও বিন্তি। চারপাশে তাকে ঘিরে অজস্র ফুল পল্লব লতা পশু পাখি পতঙ্গ। মাঝখানে উঠোনজোড়া সোনালি আলো। প্রকৃতি ও মানুষের এই একাত্মতাই তাঁর ছবির সৌন্দর্য। দ্বিতীয় ছবিটিতে মেয়েটি যেন একটু নেপথ্যে। প্রধান অবস্থানে আসে চারপাশের প্রকৃতি। অসামান্য প্রাচ্যচেতনাদীপ্ত এই ছবির পরিপ্রেক্ষিত বা পার্সপেক্টিভ বিন্যাস। তৃতীয় ছবিটি লবঙ্গলতিকার নিজের বাগানের। চতুর্থটিতে ‘পৌষমেলায় তোলা একমাত্র সপরিবার লবঙ্গলতিকার ছবি।’ ঐসলামিক অলঙ্করণ পদ্ধতির সুন্দর প্রয়োগ এখানে। দুঃখের জীবন পেরিয়ে পঞ্চম ছবিতে শিল্পী উপস্থাপিত করেন লবঙ্গলতিকাকে। এই সাফল্যের আলেখ্য অতিক্রম করে শেষ ছবিতে পাই চিন্তামগ্ন প্রবীণাকে। মিমি রাধাকৃষ্ণান ১৯৮০-র দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পী। প্রতিবাদী চেতনা এই দশকের শিল্পীদের প্রধান একটি প্রবণতা। মিমি প্রতিবাদকে প্রেমে রূপান্তরিত করে শান্তিনিকেতনের উত্তরাধিকারকে নন্দিত করেছেন।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.