অচেনা জায়গায় একদম একা পড়ে যাওয়াটাই কাল হল মহম্মদ ইকবাল ওরফে মুন্নাভাইয়ের।
২৩ দিন ধরে পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন কলকাতা পুরসভার ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের বরো চেয়ারম্যান। বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে ঘুরে আত্মীয়-পরিচিতের বাড়িতে থাকছিলেন। কখনও বিহার, কখনও উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড। যে সব জায়গা থেকে কলকাতায় ফোন করেছেন, মিনিট পাঁচেকের মধ্যে সেখান থেকে সরে পড়েছেন আত্মীয়-বন্ধুদের পরামর্শে। তাই তাঁকে ধরা যাচ্ছিল না। কিন্তু বৃহস্পতিবার রাতে ডেহরি অন শোন স্টেশন লাগোয়া বুথ থেকে মেয়েকে এবং গার্ডেনরিচের আয়রন গেট রোডের বাসিন্দা এক বিশ্বস্ত সঙ্গীকে যখন তিনি ফোন করছেন, দোর্দণ্ডপ্রতাপ তৃণমূল নেতা তখন কার্যত দিশাহারা। বুঝতেই পারছিলেন না জামশেদপুর যাবেন, নাকি ট্রেন ধরে হাওড়া। কী করবেন, বারবার জানতে চাইছিলেন। এমনিতেই শরীরে তাঁর নানা জটিলতা। সাড়ে চারশোর বেশি সুগার, শ্বাসকষ্ট, স্পন্ডেলাইটিস, কিডনির সমস্যা। তার ওপর পালিয়ে বেড়ানোর মানসিক চাপ। আলিগড়ে আশ্রয় দেওয়া তাঁর আত্মীয়রাও বেগতিক দেখে কেটে পড়েছিলেন। এই অবস্থায় সম্পূর্ণ একা, অসুস্থ মুন্নাভাই ডেহরি অন শোনে রয়ে যান আধ ঘণ্টারও বেশি। |
আর এই সময়টুকুকেই কাজে লাগায় সিআইডি। যে সমস্ত নম্বরে ইকবালের ফোন আসত, সেগুলোতে আগে থেকেই আড়ি পাতা হচ্ছিল। ফলে ডেহরির পিসিও-র হদিসও মিলে যায় চট করে। বিহার রেল পুলিশকে ইকবালের ছবি ই-মেল করে দেওয়া হয়। এর পর পিসিও মালিকের সাহায্য নিয়ে স্টেশন লাগোয়া ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে ইকবালকে ধরতে আর বেগ পেতে হয়নি। তিনিই ইকবালকে শনাক্ত করে জানান, ওই ব্যক্তিই তাঁর পিসিও থেকে কলকাতার দু’টি মোবাইল নম্বরে চারটি ফোন করেছিলেন। গ্রেফতারের পর শুক্রবার দুপুরে গয়ার আদালতে নিয়ে যাওয়া হয় ইকবালকে। সেখান থেকে ভারপ্রাপ্ত বিচারকের বাড়ি গিয়ে মিলল ট্রানজিট রিম্যান্ড। ফিরে এসে রাতে রুটি খেলেন। তার পর গোয়েন্দাদের সঙ্গে কলকাতা রওনা।
যুদ্ধকালীন তৎপরতায় প্রায় চুপিসারে অভিযান। প্রযুক্তির কারিকুরি তো আছেই, কিন্তু ফেরার নেতার ছকের ওপর টেক্কা দিয়ে তাঁকে একা এবং দিশাহারা করে দেওয়াটাই সিআইডি-র মোক্ষম চাল।
সিআইডি সূত্রের খবর, স্পেশ্যাল আইজি বিনীত গোয়েল নিজে মঙ্গলবার একটি বিশেষ সূত্র থেকে নির্দিষ্ট ভাবে জানতে পারেন, মুন্না আলিগড়ে কোথায় আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে চার অফিসারকে বিমানে দিল্লি পাঠিয়ে দেন। দিল্লি পৌঁছনোর পর দু’জন অফিসার সড়কপথে আলিগড় রওনা হন, দু’জন দিল্লিতে থেকে যান, যদি কোনও কারণে মুন্না দিল্লির দিকে চলে আসেন, সেই আশায়। এ ব্যাপারে এতটাই গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছিল যে, এডিজি শিবাজী ঘোষ ছাড়া দিল্লিতে দল পাঠানোর বিষয়টি সিআইডি-র অনেকেই জানতেন না।
মঙ্গলবার রাতেই উত্তরপ্রদেশ পুলিশের সাহায্য নিয়ে আলিগড়ে ইকবালের আস্তানায় সিআইডি হানা দেয়। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, পুলিশ হানা দিয়েছে দেখে ওই বাড়ির লোকেরা বাধা দেয়, পুলিশের দিকে ইটবৃষ্টিও শুরু করে। এরই ফাঁকে ইকবালকে নিয়ে পালান মুস্তাকিন ও নইম নামে দু’জন। সিআইডি অবশ্য ওই বাড়ি থেকে মুস্তাকিনের তিন ভাই নিজাম, সরফরাজ ও হান্নানকে গ্রেফতার করে এবং সেই সঙ্গে দিল্লি গেট থানায় মুস্তাকিন ও নইমের বিরুদ্ধেও মামলা রুজু হয়। মুস্তাকিন-নইম ততক্ষণে গাড়িতে ইকবালকে নিয়ে কনৌজ রওনা দিয়েছেন। কিন্তু ওই দু’জন যেই খবর পান যে, তাঁদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়েছে, তাঁরা আর ইকবালের সঙ্গে থাকাটা নিরাপদ মনে করেননি। বুধবার সন্ধ্যায় কনৌজে পৌঁছে দেওয়ার পর ইকবালকে একা রেখে চলে যান তাঁরা। নিঃসঙ্গ ইকবাল ট্রেন ধরে কনৌজ থেকে কানপুর হয়ে পটনা যান। বৃহস্পতিবার রাতে পৌঁছন ডেহরি অন শোনে। |
ইকবাল-নামা
|
ধারা |
অভিযোগ |
সাজা |
৩০২ |
খুন |
যাবজ্জীবন বা ফাঁসি |
১২০বি |
অপরাধের ষড়যন্ত্র |
অপরাধ অনুযায়ী |
৩৪ |
অনেকের সঙ্গে একই অপরাধ |
অপরাধ অনুযায়ী |
২৫/২৭ (অস্ত্র আইন) |
বেআইনি আগ্নেয়াস্ত্র রাখা, ব্যবহার |
অপরাধ অনুযায়ী |
|
গ্রেফতার হওয়ার পর ইকবাল ও তাঁর বাড়ির লোকেরা দাবি করেছেন, তিনি আত্মসমর্পণ করবেন মনস্থ করেই কলকাতার দিকে আসছিলেন এবং সেই সময়ে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু সিআইডি ওই দাবির সঙ্গে একমত হচ্ছে না। সিআইডি-র পাল্টা দাবি, ইকবালকে যখন ডেহরি অন শোন স্টেশনে গ্রেফতার করা হয়, তার কিছুক্ষণ আগে হাওড়াগামী জোধপুর এক্সপ্রেস ও দুন এক্সপ্রেস ছেড়ে গিয়েছে। তা ছাড়া, বৃহস্পতিবার রাতেও শেষ ফোনে ইকবালের বাড়ি থেকে তাঁকে ধরা না দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল বলেও গোয়েন্দাদের দাবি। ডেহরি অন শোন রেল পুলিশের কাছ থেকে ইকবালকে হেফাজতে নিয়ে প্রাথমিক জেরার পর সিআইডি-র দাবি, ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ডিঙি নৌকায় গার্ডেনরিচের বিচালি ঘাট থেকে হাওড়ার নাজিরগঞ্জে পৌঁছন ইকবাল। ১৪ ফেব্রুয়ারি রাজ্য ছেড়ে পালান। এর পর কোনও জায়গায় এক রাতের বেশি থাকেননি।
সিআইডি-র স্পেশ্যাল আইজি বিনীত গোয়েল বলেন, “পালিয়ে বেড়ানোর সময়ে মুন্না মোবাইল ফোন ব্যবহার না-করলেও বিভিন্ন শহরের পিসিও থেকে পরিবারের দু’জনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন।” তদন্তকারীরা আঁচ করতে পারছিলেন, মেয়ে সাবাতাজই যোগাযোগ রাখছেন। কিন্তু কোন নম্বর থেকে কথোপকথন চলছিল, সেটা তাঁরা প্রথমটায় জানতে পারেননি। দিন দশেক আগে ভিন্ রাজ্যের পাঁচটি পিসিও-র কল লিস্ট থেকে দেখা যায়, কলকাতার যে নম্বরগুলিতে ইকবাল ফোন করছেন বলে সন্দেহ, সেগুলির বাইরেও একটি নম্বর ওই কল লিস্টেই রয়েছে। অর্থাৎ ইকবালই ওই নম্বরে ফোন করছেন। গোয়েন্দারা দেখেন, ওই মোবাইল টাওয়ারের অবস্থান গার্ডেনরিচে এবং সেটি সাবাতাজই ব্যবহার করছেন। তার পর থেকে আড়ি পাততে গোয়েন্দাদের আর অসুবিধে হয়নি। |