মুখে এক বারের জন্য তাঁর নাম না-নিলেও প্রকাশ্য সভায় সারাক্ষণ তাঁকে পাশে বসিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিলেন, তিনি ফিরহাদ (ববি) হাকিমকে ‘দূরে ঠেলেননি’! বুঝিয়ে দিলেন, শত বিতর্ক এবং বিরোধীদের হাজারও দাবি সত্ত্বেও পুরমন্ত্রীর আসন রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর পাশেই!
গার্ডেনরিচ-কাণ্ড ও মহম্মদ ইকবালকে (মুন্না) নিয়ে রাজ্য-রাজনীতি তোলপাড় হওয়ার পরে শুক্রবার স্বাস্থ্য ভবনে পাশাপাশি আসনে দেখা গেল মুখ্যমন্ত্রী মমতা ও পুর ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদকে। কয়েক দিন মহারাষ্ট্র নিবাসের এক অনুষ্ঠানেও দু’জনকে কাছাকাছি দেখা গিয়েছিল। তবে সেখানে স্বাস্থ্য ভবনের মতো সংবাদমাধ্যমের ক্যামেরার প্রবেশাধিকার ছিল না।
গার্ডেনরিচের ঘটনায় ইকবাল ওরফে মুন্নাকে ‘প্রশ্রয়’ দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল ফিরহাদের বিরুদ্ধে। প্রথমে তিনি ইকবালের পাশে দাঁড়ালেও পরে ঘটনার স্রোত পুরোপুরি তৃণমূলের বরো চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে চলে যাওয়ায় তাঁর সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করতে শুরু করেছেন পুরমন্ত্রী। এখন তাঁদের ফোনও মন্ত্রী ধরছেন না বলে ইকবালের বাড়ির লোকজন আক্ষেপ করেছেন। স্বাস্থ্য ভবনে যাওয়ার আগে এ দিনও মহাকরণে ফিরহাদকে প্রশ্ন করা হয়, মুন্না কবে ফিরবেন? মন্ত্রীর উত্তর ছিল, “সেটা উনি জানেন আর উপরওয়ালা জানে!” |
স্বাস্থ্যভবনের একটি অনুষ্ঠানে পাশাপাশি ফিরহাদ-মমতা। —নিজস্ব চিত্র |
ঘটনাচক্রে, স্বাস্থ্য ভবনে মমতা-ফিরহাদের পাশাপাশি অবস্থানের অব্যবহিত আগেই মন্ত্রিসভা থেকে পুরমন্ত্রীর অপসারণ দাবি করেন বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু। ফ্রন্ট বৈঠকের পরে এ দিন আলিমুদ্দিনে বিমানবাবু বলেন, “গার্ডেনরিচের ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে মন্ত্রী মুখ্যমন্ত্রীকে কী বলেছেন, তা-ও টিভি ফুটেজে দেখা যাচ্ছে। মন্ত্রী বলছেন, ‘দিদি আমি সব সামলে নেব’! তিনি অবশ্যই ঘটনায় জড়িত। তদন্ত করা উচিত। যে মন্ত্রী জড়িত বলে নিজেই প্রমাণ দিয়েছেন, তদন্তের স্বার্থে তাঁকে অপসারণ করা উচিত।” গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে ফিরহাদকে অপসারণের দাবি তারা প্রচারে নিয়ে আসবে বলেও এ দিন ফ্রন্ট বৈঠকে ঠিক হয়েছে।
এর এক ঘণ্টার মধ্যেই স্বাস্থ্য ভবনের ছবি অবশ্য বলে দিচ্ছে, বিরোধীদের দাবিকে আমল দিচ্ছেন না মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী। গার্ডেনরিচ-কাণ্ডে মমতা ফিরহাদের ‘ডানা ছাঁটছেন’ বলে কোনও কোনও মহল থেকে যা বলা হচ্ছিল, তা যে সত্যি নয়, সেটা বোঝা গিয়েছিল নলহাটিতে পুরমন্ত্রীর রোড-শো ও সম্প্রতি মহারাষ্ট্র নিবাসে দু’জনকে একসঙ্গে দেখা যাওয়ায়। সেটা আরও স্পষ্ট হল এ দিন স্বাস্থ্যভবনে।
মুখ্যমন্ত্রী আসার মিনিট পাঁচেক আগে এ দিন দুপুরে স্বাস্থ্যভবনে পৌঁছোয় পুরমন্ত্রীর গাড়ি। মমতা আসার পরে হাস্যমুখ ফিরহাদের নেতৃত্বেই স্বাস্থ্য অধিকর্তারা তাঁকে ভিতরে নিয়ে যান। তবে সাম্প্রতিক ঘটনাবলিতে তিনি যে কিছুটা অস্বস্তিতে, তা এ দিন পুরমন্ত্রীর শারীরিক ভাষাতেই স্পষ্ট ছিল। এক বারের জন্য পরস্পরের সঙ্গে কথা না-বললেও বৈঠকে এবং সাংবাদিক সম্মেলনে আগাগোড়া মমতার ঠিক ডান দিকের আসনে বসেছিলেন পুরমন্ত্রী। সাংবাদিকেরা কেউ মমতাকে ফিরহাদ বিষয়ে কিছু প্রশ্ন করেননি। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জবাব দেওয়ার ঢঙে ফিরহাদের চেয়ারের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, “পুরসভাগুলো থেকে এসেছে, কারণ এখানে মশাবাহিত রোগ নিয়ে
আলোচনা হয়েছে। আমি চাই, প্রত্যেকটি পুরসভা বিষয়টায় গুরুত্ব দিক। শোভনেরও (মেয়র) আসার কথা ছিল। কিন্তু সৌরভের (গঙ্গোপাধ্যায়) বাবা মারা গিয়েছেন বলে ও ওখানে গিয়েছে। তবে কৃষ্ণা (চক্রবর্তী, সল্টলেক পুরসভার চেয়ারপার্সন) এসেছেন, খলিল (আহমেদ) এসেছেন।”
ইকবালকে নিয়ে রাজনৈতিক জলঘোলা শুরু হওয়ার পরেই মমতার পাশে কিছু দিন আর দেখা যাচ্ছিল না পুরমন্ত্রীকে। তাঁর শূন্যস্থানে দেখা যাচ্ছিল মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়কে। আমতলায় জলপ্রকল্পের উদ্বোধনে অভ্যাগতদের তালিকায় পুরমন্ত্রীর নাম থাকলেও তিনি সেখানে যাননি। কিছু দিন আগে ভাঙড়ের ঘটনার পরে মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানের দলীয় পোস্টার-ব্যানার থেকে প্রাক্তন বিধায়ক আরাবুল ইসলামের নাম বাদ দেওয়া হয়েছিল। ফিরহাদের বেলায় অবশ্য তা হয়নি। মুখ্যমন্ত্রী সরাসরি তাঁর নাম না-নিয়েও তাঁকে পাশে বসিয়ে এ দিন যা বার্তা দেওয়ার, দিয়ে দিয়েছেন!
স্বাস্থ্যভবন সূত্রের খবর, এ দিনের বৈঠকে ডেঙ্গি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন মুখ্যমন্ত্রী। কেন ডেঙ্গি নিয়ে রাজ্যে কোনও টাস্ক ফোর্স নেই, কেন কোনও নোডাল অফিসার নেই, তা জানতে চান তিনি। উত্তর না-পেয়ে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের ভর্ৎসনাও করেন। অবিলম্বে টাস্ক ফোর্স ও নোডাল অফিসার নিয়োগের নির্দেশ দেন মুখ্যমন্ত্রী। বৈঠক শেষে ফিরহাদের সঙ্গেই স্বাস্থ্যভবনের নীচে নামেন মুখ্যমন্ত্রী। তার পরে চড়েন দু’টি আলাদা গাড়িতে। প্রায় একই সঙ্গে গাড়ি দু’টি স্বাস্থ্যভবন ছাড়ে। |