ভারত যদি পরমাণু বোমা বানায়, তবে ঘাস খাইয়া থাকিতে হইলেও পাকিস্তান পারমাণবিক অস্ত্রে বলীয়ান হইবে জুলফিকার আলি ভুট্টোর অর্ধ শতক পূর্বের উক্তি ইতিহাসে অবিস্মরণীয় হইয়াছে। উত্তর কোরিয়ার লক্ষ লক্ষ মানুষ বছরের পর বছর প্রায় আক্ষরিক অর্থেই ঘাস খাইয়া জীবন কাটাইতেছেন, অথবা ধারাবাহিক দুর্ভিক্ষের বলি হইতেছেন। এবং উত্তর কোরিয়া ২০০৬ ও ২০০৯ সালের পরে তৃতীয় বার পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটাইল। রাষ্ট্রক্ষমতা যাঁহাদের হাতে, কোথাও কখনও তাঁহাদের ঘাস খাইতে হয় না। অগণিত সাধারণ মানুষের অনাহার এবং সামরিক ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য রাষ্ট্রনায়কদের ব্যয়সাধ্য অভিযান অতএব সমান্তরাল ভাবে চলিতে থাকে, ইহাতে কোনও নূতনত্ব নাই। তবুও উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক ‘প্রগতি’র কিছু বৈশিষ্ট্য আছে। ঠান্ডা লড়াই-উত্তর বিশ্বে কার্যত এই একটি দেশই এখনও লৌহ-যবনিকা সরায় নাই, কোরিয়া যুদ্ধের (১৯৫০-৫৩) শেষে, ঠিক ষাট বছর আগে কিম ইল সংয়ের সর্বগ্রাসী শাসনে মস্কোর মদতে যে বিচ্ছিন্নতার সাধনা শুরু হয়, তাঁহার পুত্র কিম ইল জংয়ের জমানায় তাহাই চলিতে থাকে এবং ২০১১’র শেষে তাঁহার মৃত্যুর পরে তদীয় পুত্র কিম জং আন-এর নেতৃত্বে রুদ্ধদ্বার স্বৈরতন্ত্রই বলবৎ রহিয়াছে। অর্থনীতি বহু কাল যাবৎ মৃত। অধিকাংশ মানুষ ভয়াবহ অপুষ্টি, অস্বাস্থ্য, অশিক্ষার পূর্ণগ্রাসে বিধ্বস্ত অর্ধ শতাব্দীর ‘স্বনির্ভরতা’র তাড়নায় উত্তর কোরিয়ার নাগরিকদের গড়পড়তা উচ্চতা এখন দক্ষিণ কোরিয়ার তুলনায় আড়াই ইঞ্চি কম! এই আগ্নেয়গিরির শিখরে আপন প্রভুত্ব কায়েম রাখিবার জন্য শাসকরা পারমাণবিক শক্তির সাধনায় রত, ওই শক্তি দেখাইয়াই তাঁহারা আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা প্রতিহত রাখিতে চাহেন।
এবং এ পর্যন্ত সেই লক্ষ্য পূরণেও তাঁহারা সফল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ উন্নত দুনিয়া উত্তর কোরিয়াকে পারমাণবিক অস্ত্র ও আধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র সহ মারণাস্ত্রের উৎপাদন হইতে নিরস্ত করিতে বহু যত্ন করিয়াছে এক দিকে তর্জনগর্জন ও নিষেধাজ্ঞা এবং অন্য দিকে চিন ও রাশিয়া ছয় দেশের গোষ্ঠীর মধ্যস্থতায় বোঝাপড়ার চেষ্টা চলিতেছে। বৃথা চেষ্টা। নিষেধাজ্ঞার বলি হইয়াছেন সাধারণ মানুষ, শাসকরা বহাল তবিয়তে। বাহির হইতে প্রকৃত চাপ সৃষ্টি করিতে পারে একমাত্র চিন, কারণ সোভিয়েত-উত্তর বিশ্বে বেজিংই পিয়ংইয়াংয়ের একক সহায়। কিন্তু চিনের কাছে উত্তর কোরিয়া কূটনৈতিক হাতিয়ার, এশিয়ায় ওয়াশিংটনের ক্রমবর্ধমান ভূমিকার প্রেক্ষিতে যে হাতিয়ারটি হারাইতে বেজিং প্রস্তুত নহে। সুতরাং ঘাস (না) খাইয়া পারমাণবিক শক্তির সাধনা চলিবে। অসার দাপট দেখাইবার চেষ্টা না করিয়া ওয়াশিংটন এবং সম্প্রদায়ের বরং ভাবা উচিত, কী ভাবে তরুণ কিম জং আনকে লৌহযবনিকা সরাইতে প্রণোদিত করা যায়। ইহার পাশাপাশি হয়তো দেশের নাগরিকদের বাহিরের দুনিয়ার স্বাদ বর্ণ সৌন্দর্য সমৃদ্ধির সংবাদ অনেক বেশি সরবরাহ করিতে পারিলে তাঁহারাই সেই মুক্তির জন্য রাষ্ট্রনায়কদের উপর চাপ সৃষ্টি করিবেন। পূর্ব ইউরোপ দেখাইয়াছে, যবনিকা অপসারণের তাহাই শ্রেষ্ঠ পথ। |