বাংলাদেশের বিরাট বাজার খুলে যাচ্ছে এ রাজ্যের বাংলা সিনেমার কাছে। ভারতের ছবি তাদের সিনেমা হলগুলিতে অবাধ প্রদর্শনের জন্য আইন সংশোধন করছে বাংলাদেশ সরকার। শুক্রবার কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এ কথা জানিয়ে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আইন সংশোধনের খুঁটিনাটি প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে।
বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়ে টালিগঞ্জের নায়ক প্রসেনজিৎ বলেন, “জনাব ইনু দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই এ বিষয়টি নিয়ে তৎপর হয়েছেন। এর ফলে হিন্দি সিনেমাকেও টপকে যাবে বাংলা সিনেমার বাজার। বাংলাদেশেও অনেক ভাল সিনেমা হয়, সেগুলি যাতে এ বাংলার হলগুলিতে প্রদর্শিত হয়, সে বিষয়েও চেষ্টা করছি।”
ভারতীয় সিনেমার ‘আগ্রাসন’ থেকে ঢালিউড-কে (ঢাকার চলচ্চিত্র শিল্পকে এ নামেই ডাকা হয়) বাঁচাতে সেনা-শাসকদের আমলে আইন করে বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমার প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। একমাত্র ভারত-বাংলাদেশ যৌথ প্রযোজনা হলে তবেই সেই সিনেমা ও দেশের হলে দেখানো যায়। এই আইন থেকে বাঁচতে এক সময়ে নামকা ওয়াস্তে যৌথ প্রযোজনার কৌশল নিয়েছিলেন দু’দেশের প্রযোজকরা। কিন্তু তাতে দুই বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পের তেমন কোনও লাভ হয়নি।
বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী ইনু বলেন, “কয়েক মাস আগে তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পেয়েই আমি বিষয়টিতে অগ্রাধিকার দিই। কারণ, ইন্টারনেট-ওয়েবসাইটের যুগে আইন করে কোনও দেশের সিনেমার প্রদর্শন বন্ধ করে রাখা হাস্যকর।” তাঁর কথায়, দুই বাংলার মানুষ একই ভাষায় কথা বলেন, একই তাঁদের সংস্কৃতি, বিনোদনের চাহিদাও এক। দরজা বন্ধ করে রাখার বদলে এই পরিস্থিতির সুযোগ নিতে পারলে দু’দেশের চলচ্চিত্রশিল্পই লাভবান হতে পারে। এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত হাজার হাজার মানুষের আর্থিক সমৃদ্ধিও ঘটতে পারে। “দুই বাংলা হাত ধরলে সুযোগ অনেক। বাড়বে কর্মসংস্থানও,” বললেন ইনু। |
|
|
হিন্দিকেও টপকে যাবে বাংলা সিনেমার বাজার।
প্রসেনজিৎ |
দুই বাংলা হাত ধরলে সুযোগ অনেক।
হাসানুল হক ইনু,
বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী |
|
বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী জানান, সে দেশের চলচ্চিত্র শিল্পের সঙ্কট কাটাতেই তিনি হাত মেলানোর প্রস্তাব নিয়ে হাজির হয়েছিলেন কলকাতার চলচ্চিত্র মহলের কাছে। কিন্তু দেখলেন এখানেও একেবারে একই চিন্তা-ভাবনা রয়েছে গৌতম ঘোষ, প্রসেনজিৎ, ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো টলিউডের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিত্বদের। বাংলা চলচ্চিত্র শিল্পের স্বার্থেই তাঁরাও চান দুই বাংলার সিনেমাই দুই বাংলার বাজারে অবাধে মুক্তি পাক, জনপ্রিয় হোক।
কিন্তু জনপ্রিয়তার স্লোগান তুলেই এক সময়ে একের পর এক ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ ধরনের সিনেমা তৈরি হয়েছিল যৌথ প্রযোজনায়। আবার কি সেই যুগ ফিরে আসবে? এই প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী, সে দেশের পরিচিত বামপন্থী নেতা হাসানুল হক ইনু বলেন, “তা কেন? যৌথ প্রয়োজনায় সিনেমার বাজেট বড় হবে। উন্নত প্রযুক্তি আসায় সমৃদ্ধ হবে বাংলা সিনেমা। বেসরকারি প্রযোজনায় হওয়া সিনেমায় বাণিজ্যের প্রশ্নটি নিশ্চয়ই বড় হবে। কিন্তু তা যাতে শালীন ও সুস্থ রুচির হয়, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।” শালীনতা মাপা যাবে কী ভাবে? সে ক্ষেত্রে কি কোনও নিষেধাজ্ঞা রাখা হচ্ছে? ইনুর যুক্তি, কম বাজেটে সিনেমাকে জনপ্রিয় করতেই প্রযোজকদের অশালীনতার কৌশল নিতে হয়। বাজেট বড় হলে সেই প্রবণতাও কমবে।
প্রসেনজিৎ বলেন, বাংলা সিনেমাকে বাঁচতে হলে বাজার বাড়ানো ছাড়া গতি নেই। দেশের অন্যতম বড় বণিকসভা ফিকি-র সঙ্গে হাত মিলিয়ে টলিউড সেই চেষ্টাটাই করছিল। সেই সময়েই বাংলাদেশের তথ্যমন্ত্রী প্রায় একই প্রস্তাব নিয়ে এগিয়ে আসেন। প্রসেনজিৎ বলেন, “ইনুভাইয়ের আন্তরিকতা ও উদ্যোগের জন্যই এই মাস দেড়েকে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমরা ঢাকায় গিয়ে বোঝাতে পেরেছি, শুধু দরজা বন্ধ করে বলিউডের আগ্রাসন থেকে বাঁচা যায় না। কারিগরি, গল্প, লোকেশনে মুম্বইয়ের ছবিকে টক্কর দিতে হবে। আমরা তা করে দিব্যি টিঁকে রয়েছি। দুই বাংলার বাজার অবারিত হলে এই সুযোগ যেমন বেড়ে যাবে, তেমনই ৩০ কোটি মানুষের দরবারে পৌঁছবে আমাদের ছবি।”
ইনু বলেন, “ভারতের সিনেমার অবাধ প্রদর্শনের জন্য আমরা যেমন উদ্যোগী হয়েছি, এ দেশেরও উচিত বাংলাদেশের সিনেমা প্রদর্শনে বাধানিষেধ তুলে নেওয়া। তবে দু’দেশের চলচ্চিত্র শিল্পই লাভবান হতে পারে।”
প্রসেনজিৎ বললেন, “আমরাও উদ্যোগী হয়েছি। শীঘ্রই বাংলাদেশের কিছু সিনেমা এ দেশের হলে মুক্তি পাচ্ছে।”
শুধু বাজার খোলা নয়, উন্নত সিনেমা হল গড়ে তোলার মতো পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে বিনিয়োগও চায় বাংলাদেশ। ইনু বলেন, “ভারতে বড় বড় মাল্টিপ্লেক্স তৈরির পরে হলে দিয়ে সিনেমা দেখার চলটা বেড়েছে। আমরা চাই ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশেও এ ধরনের বড় সিনেমা হল তৈরি করুক। যৌথ উদ্যোগে সিনেমার আধুনিক ল্যাবরেটরি তৈরি হোক, তৈরি হোক স্টুডিও। হলিউড থেকে আধুনিক প্রযুক্তি আনা হোক বাংলা সিনেমায়। দু’দেশের কলাকুশলীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও হোক।”
আপাতত দু’দেশে দু’টি উপদেষ্টা কমিটি গড়া হচ্ছে, যারা বাজার খোলার প্রতিবন্ধকতাগুলো খতিয়ে দেখবেন। সে সব কী ভাবে কাটিয়ে তোলা যায়, তার সুলুক-সন্ধান দেবেন। তবে দুই বাংলার চলচ্চিত্র শিল্পের আগ্রহে যখন খেদ নেই, কোনও প্রতিবন্ধকতাই ধোপে টিকবে না বলে মনে করেন ইনু। আর প্রসেনজিৎ বলছেন, “এ আমার শেষ লড়াই। এর শেষ দেখে ছাড়ব। দুই বাংলার সিনেমাকে মেলানো গেলে কাউকে আর মুখ শুকিয়ে বসে থাকতে হবে না।” |