সশস্ত্র বাহিনী বিশেষ ক্ষমতা আইন (আফস্পা) যে যুগপৎ দমনমূলক এবং অকার্যকর একটি আইন, এমন কথা মনে করিবার যথেষ্ট যুক্তি আছে। এই আইন সন্ত্রাস-উপদ্রুত রাজ্যগুলিতে জঙ্গি তৎপরতা হ্রাসে সমর্থ তো হয়ই নাই, উপরন্তু সেনা-কর্তৃপক্ষকে বিপুল ক্ষমতা দিবার ফলে নিরীহ, নিরপরাধ মানুষদের নিছক সন্দেহবশে হেনস্থা, হয়রানি ও নিগ্রহ করার প্রবণতা অনেক বাড়িয়া গিয়াছে। জনসাধারণের মানবাধিকার যথেচ্ছ লঙ্ঘনের দায়ও সেনার উপর বর্তাইয়াছে। কিন্তু এই আইন রদ করার কিংবা নিদেনপক্ষে সংশোধন করার যাবতীয় শুভেচ্ছা ও প্রয়াস নাকি সেনাকর্তাদের বাধায় আটকাইয়া গিয়াছে। অন্তত প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পালনিয়াপ্পন চিদম্বরমের বক্তব্য শুনিয়া তেমনই মনে হওয়া স্বাভাবিক। বস্তুত, তিনি এই আইনটির পরিমার্জন না-হওয়ার দায় কার্যত দেশের সামরিক কর্তৃপক্ষের ঘাড়ে চাপাইয়া দিয়াছে। তাঁহার কথার ইঙ্গিত ইহাই যে, এই আইন বহাল রাখিতে সেনাবাহিনীর বিশেষ তাগিদ আছে, সেই কারণেই ইহাকে বিদায় জানানো যাইতেছেন না। সরকার যেন এই বিষয়ে নিতান্ত ‘অসহায়’।
আর এখানেই প্রশ্ন। ভারত তো সামরিক বাহিনী শাসিত কোনও রাষ্ট্র নয়, ইহা একটি গণতন্ত্র। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এই দেশে একটি সম্পূর্ণ অসামরিক শাসনব্যবস্থা পরিচালনা করিয়া থাকেন। এখানে আইনের শাসন চালু রাখার জন্য পুলিশ বাহিনী রহিয়াছে। তথাপি আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করিতে সামরিক বাহিনী মোতায়েন কিংবা তাহার হাতে বিশেষ ক্ষমতা তুলিয়া দেওয়া সংক্রান্ত কোনও আইন যদি সাময়িকভাবে বলবৎ করিতে হয় এবং অঞ্চলবিশেষে তাহা প্রয়োগ করিতে হয়, অসামরিক শাসনকর্তারাই সে বিষয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণের একচেটিয়া অধিকারী। আইনটির প্রয়োগ রদ করা কিংবা তাহার দমনমূলক ধারাগুলির অমানবিকতা হ্রাস করার সিদ্ধান্ত যদি সেই অসামরিক শাসনকর্তারা লইয়া থাকেন, তবে তাহার এক্তিয়ারও বিলক্ষণ তাঁহাদের রহিয়াছে। এ ব্যাপারে সেনাকর্তাদের অনুমোদন জরুরি হইবে কেন? প্রতিরক্ষা মন্ত্রককে নিশ্চয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক জিজ্ঞাসা করিতে পারে, প্রতিরক্ষা মন্ত্রকও পারে এ ব্যাপারে সেনাকর্তাদের মতামত লইতে। কিন্তু সিদ্ধান্ত লওয়ার অধিকার কেবল অসামরিক রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষেরই, সেনাকর্তাদের নয়।
ভারত নিশ্চয় তাহার সেনাধ্যক্ষদের সম্মান করে, কিন্তু সেনা-ছাউনিকে তোষণ করিয়া চলার কোনও দায় দেশের নির্বাচিত অসামরিক শাসকদের থাকিতে পারে না। জনপ্রতিনিধি হিসাবে তাঁহাদের জবাবদিহির দায় কেবল নির্বাচকমণ্ডলীর কাছে। প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অতএব জেনারেলদের অকারণ গুরুত্ব দিতেছেন। রণক্ষেত্রে কী কৌশল লওয়া হইবে, তাহা তাঁহারা নির্ধারণ করিতেই পারেন। কিন্তু যুদ্ধ আদৌ করা হইবে কি না, নিজ দেশবাসীরই একাংশের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা গণতন্ত্রসম্মত কি না, সেই সিদ্ধান্ত সেনাবাহিনীর হাতে ছাড়িয়া দেওয়া যায় না। আফস্পার মতো আইনের প্রতি সেনাকর্তাদের, কিংবা আরও নির্দিষ্ট করিয়া বলিলে অকুস্থলে মোতায়েন সেনাবাহিনীর জওয়ানদের বিশেষ অনুরাগ থাকিতেই পারে। সেই অনুরাগকে তাহাদের অবস্থান হইতে যুক্তিসঙ্গত বলিয়া গণ্য করিবারও কারণ থাকিতে পারে। কিন্তু সেনাবাহিনীর অবস্থান আর গণতান্ত্রিক সরকারের অবস্থান সর্বদা নীতিগত ভাবে এক হইবে কেন? বিশেষত, যেখানে তাহার বিপরীত অভিমত বা দাবি অত্যন্ত ব্যাপক এবং প্রবল? মণিপুর, নাগাল্যান্ড, অসম, ত্রিপুরা ও জম্মু-কাশ্মীরে সেনাবাহিনীর ভূমিকা প্রায়শ এতটাই জনবিরোধী বলিয়া সমালোচিত হইয়াছে যে, সেখানকার জনসমাজ এমনকী নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের তরফেও সেনা প্রত্যাহারের কিংবা আফস্পা রদ করার জোরালো দাবি উঠিয়াছে। কেন্দ্রীয় সরকার যদি সেই দাবিকে ন্যায়সঙ্গত মনে করে, তবে সেনাকর্তাদের মুখ ভার হইবে বলিয়া তাহা মানিয়া না-লওয়া হাস্যকর। প্রচুর শক্তিশালী অস্ত্র হাতে থাকিলে যেমন তাহার অপপ্রয়োগের সম্ভাবনা বাড়িয়া যায়, প্রচুর আইনি নিপীড়নের ক্ষমতা হাতে থাকিলেও তাহার অপব্যবহারের আশঙ্কা প্রবল হইয়া ওঠে। ইহাই বাস্তব। |