বরণীয় নেতার আলোচনায় নেতাজিতেই মগ্ন আসর
সাতচল্লিশের সেই মধ্যরাতে প্রায় তারুণ্যের দোরগোড়ায় তিনি। “আমাদের নেতা তখন মহাত্মা গাঁধী বা নেতাজি। জানি না, এখনকার ছেলেরা কার কথা বলে!”
কথাটা বললেন প্রাক্তন সাংসদ তথা শিক্ষাবিদ অশীতিপর কৃষ্ণা বসু। শুনে হাততালিতে ফেটে পড়ল প্রেক্ষাগৃহ। শনিবার সন্ধ্যায় বইমেলার মাঠে, ‘কলকাতা লিটারারি মিট’-এর আসরে।
‘বরণীয় কারা’ কিংবা ‘চেঞ্জিং বেঙ্গলি আইকন্স’ শীর্ষক আলাপচারিতা ওই এক বারই সমসময়ের বিপদসীমার ধার ঘেঁষে এসেছিল। বাঙালির নেতা কারা? জবাব খুঁজতে এ কালের ধারে-কাছে ঘেঁষেননি বক্তারা। বরং নেতৃত্বের মহিমা যাচাই করতে প্রধানত সুভাষচন্দ্র বসুর জীবন-ইতিহাসের আনাচে-কানাচেই ঘোরাফেরা চলল। কিন্তু ১০০ বছরেরও আগে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময়ে লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি প্রবন্ধের সূত্র ধরেই ‘নেতাহীন বাঙালি’র এই সময়ের হতাশা উঠে এসেছে। ‘দেশনায়ক’ প্রবন্ধে ঝগড়াবাগীশ বাঙালির ছন্নছাড়া দশায় হতাশ রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘জাহাজ চালাইতে গেলে কাপ্তেনের দরকার হয়!’ সভাকক্ষের বাইরে আলোচনা শেষে বক্তাদের কিন্তু সমকালের বঙ্গজীবনে ‘কাপ্তেনহীনতা’ নিয়েও প্রশ্ন শুনতে হল।
দুই বক্তা কৃষ্ণাদেবী ও তাঁর পুত্র সুগত বসু, দু’জনেই সুভাষচন্দ্রের ঘনিষ্ঠ পরিজন। সুগত শিক্ষাবিদ তথা বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মেন্টর গ্রুপের চেয়ারম্যানও বটে! সুগত হাসলেন, “নেতাজির মতো নেতারা তো চরম সঙ্কটের পরিস্থিতিতেই উঠে আসেন! হয়তো ভবিষ্যতে কখনও ফের তেমন কেউ আসবেন।” আর কৃষ্ণার সান্ত্বনা, “বরণীয় মানুষ (আইকন) কিন্তু পরেও এসেছেন। যেমন, সত্যজিৎ রায় বা সৌরভ!”
মোটের উপর বর্তমানের পাশ কাটিয়ে সন্ধের একটি ঘণ্টা বাঙালি সেই নেতাজিতেই ডুবে থাকল। এই বইমেলার বিশেষ প্রাপ্তি সুগত বসুর নতুন বই ‘দেশনায়ক: সুভাষচন্দ্র বসু ও ভারতের মুক্তিসংগ্রাম’ (আনন্দ পাবলিশার্স)। নেতাজিকে ঘিরে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ দু-দশকের ইতিহাস-আলেখ্য। মূল ইংরেজি গ্রন্থ (হিজ ম্যাজেস্টিস অপোনেন্ট: সুভাষচন্দ্র বোস অ্যান্ড ইন্ডিয়াজ স্ট্রাগল আগেনস্ট এম্পায়ার)-এর এই ভাষান্তর হয়েছে সেমন্তী ঘোষের হাতে।
বাংলায় বইয়ের নামটা এমন পাল্টে গেল কেন? সান্ধ্য-আলোচনার সঞ্চালক সেমন্তীই প্রশ্নটা তুললেন। “বাইরের দুনিয়ার চোখে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার প্রতীক হলেও বাঙালির কাছে সুভাষচন্দ্র তো দেশনায়কই,” বললেন সুগত। ১৯০৫-এ লেখা ‘দেশনায়ক’ শব্দটায় রবীন্দ্রনাথ পরে সুভাষচন্দ্রকেই অভিষিক্ত করেছিলেন। ১৯৩৯-এ একটি সভার জন্য লেখা বক্তৃতায় এই সম্বোধন করেন রবীন্দ্রনাথ। সুগত বলছিলেন, “একটা সময়ে সুভাষকে নিয়ে তাঁর কিছু সংশয় থাকলেও প্রবীণ রবীন্দ্রনাথ কিন্তু মধ্যদিনের আলোকে উদ্ভাসিত সুভাষকে নেতা হিসেবে মেনে নেন।”
নেতা তিনিই, যিনি তাঁর অনুগামীদের থেকে আলাদা থাকেন না। আফগানিস্তান ও সাবেক সোভিয়েত সীমান্ত ঘেঁষা পাহাড়ে সুভাষ ও তাঁর বাহিনীর লম্বা ট্রেকিংয়ের কথা উঠে এল আলোচনায়। কৃষ্ণা-সুগতরা বললেন, আজকের পাকিস্তানে নেতাজির প্রতি তাঁর ফৌজিদের আনুগত্যের কাহিনি। আজকের বাঙালি স্তব্ধ হয়ে শুনল সেই নেতার কথা, সদ্য মেয়ে হওয়ার দু’হপ্তা বাদে জার্মানির বিদেশমন্ত্রীকে যিনি চিঠি লিখে বলছেন, “ঝুঁকি থাকলেও আমায় এখনই সাবমেরিনে করে এশিয়ায় কোথাও পাঠিয়ে দিন, দেশের স্বাধীনতা-যুদ্ধে আমার দরকার আছে।” সুভাষের আদর্শ বিবেকানন্দ-দেশবন্ধু বা গাঁধীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছুঁয়ে গেল আলোচনা। দীর্ঘদিন অনুচ্চারিত নেতাজির গার্হস্থ্য জীবন নিয়ে বাঙালির ‘অতি স্পর্শকাতরতা’র প্রসঙ্গও বাদ পড়েনি। নেতাদের অঙ্গে ঋষিত্ব আরোপে বাঙালি তুখোড়। সুগত বললেন, “আমার খুড়িঠাকুমা এমিলি শেঙ্কেল্স ইতিহাসে উপেক্ষিতা। ওঁর ত্যাগ স্বীকারের তুলনা নেই।” কৃষ্ণার দাবি, “নতুন প্রজন্ম কিন্তু নেতাজির জীবনটা সহজ চোখেই দেখে।” নেতার আকালেও নেতাদের নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গির বদলের আভাসটুকুই বাঙালির প্রাপ্তি।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.