রাজ্যের কাছ থেকে টাকা না মেলায় সমস্যার মুখে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের (পিএইচই) জল প্রকল্পগুলি। প্রকল্প চালাতে দৈনন্দিন যে টাকার প্রয়োজন, তার নিয়মিত সংস্থান করতে পারছে না রাজ্য। প্রকল্পগুলির রক্ষণাবেক্ষণও হচ্ছে না টাকার অভাবে। ফলে, বহু এলাকায় জল সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। প্রকল্পগুলি চালু রাখতে গেলে জলকর বসানো যায় কি না, সে প্রশ্নও উঠেছে ব্লক এবং জেলা স্তর থেকে।
রাজ্যের জনস্বাস্থ্য কারিগরিমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, বকেয়া টাকার পরিমাণ বেশি নয়। তাঁর কথায়, “পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ হল নির্বাচিত সংস্থা। তাদের উপরে রাজ্য সরকার কিছুই চাপাতে পারে না। এ বিষয়ে তাদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।”
রাজ্যের গ্রামীণ এলাকায় রয়েছে এমন প্রায় আড়াই হাজার জলপ্রকল্প। তার মধ্যে ২,২৪৫টি প্রকল্প রয়েছে ঠিকাদারদের হাতে। বাকি প্রকল্পগুলি রয়েছে বিভিন্ন জেলা পরিষদ বা পুরসভার অধীনে। প্রকল্পগুলির কোনওটি কেন্দ্র, কোনওটি রাজ্য গড়েছে। কিছু প্রকল্প হয়েছে কেন্দ্র এবং রাজ্যের যৌথ তহবিলে। ঠিকাদার পরিচালিত জলপ্রকল্পগুলির ক্ষেত্রে পাম্প অপারেটরদের বেতন এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচ জোগায় জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের অনুমোদিত ঠিকা সংস্থাগুলি। সেই টাকা তারা পরে পেয়ে যায় দফতর থেকেই। অল্প কয়েকটি প্রকল্প অবশ্য জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের কাছ থেকে সরাসরি অধিগ্রহণ করেছে কিছু
জেলা পরিষদ এবং বিভিন্ন পুরসভা।
২০১১-র শেষ দিকে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের তরফ থেকে জেলা পরিষদগুলিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন ঠিকাদার পরিচালিত জলপ্রকল্পগুলিও অধিগ্রহণ করে। পাম্প অপারেটরদের বেতন এবং রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও তাদেরই নিতে হবে নির্দেশে এমন কথাও বলা ছিল। একই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল পঞ্চায়েত সমিতি এবং গ্রামীণ এলাকার পুরসভাগুলিকে। কিন্তু অনেকেই জানিয়ে দিয়েছে, তাদের পক্ষে এই সব জল প্রকল্পের দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। কারণ, প্রকল্পগুলি চালানোর জন্য যে টাকার প্রয়োজন তা কী ভাবে জোগাড় হবে, সে বিষয়ে নির্দেশে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। কয়েকটি পঞ্চায়েত সমিতির তরফে প্রস্তাব দেওয়া হয়, জলকর বসিয়ে যদি খরচ তোলার ব্যবস্থা করা যায়, তা হলে অধিগ্রহণের বিষয়টি তারা ভেবে দেখতে পারে। কিন্তু এর উত্তরে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের কাছ থেকে আর কোনও নির্দেশ আসেনি। ফলে, সমস্যা রয়েছে একই জায়গায়।
প্রকল্পগুলি চালু রাখতে প্রতি মাসে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের গড়ে ১০ কোটি টাকা খরচ হয়। কিন্তু এই টাকারও সংস্থান তারা নিয়মিত করতে পারছে না। ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের কাছে ঠিকদার সংস্থাগুলির বকেয়া রয়েছে ১৪৯ কোটি টাকা। ঠিকাদারদের সংগঠনের পক্ষে সুব্রত দাসের দাবি, “চোদ্দো মাসের টাকা বকেয়া। গাঁটের কড়ি খরচ করে পাম্প অপারেটরদের কোনও মতে কিছুটা বেতন দিয়েছি। গত চার মাস ধরে আর বেতন দিতে পারছি না। রক্ষণাবেক্ষণের কাজ পুরোপুরি বন্ধ।”
জেলা পরিষদ অধিগৃহীত জল প্রকল্পগুলি পঞ্চায়েত সমিতির মাধ্যমে চালায়। পাম্প অপারেটরদের বেতন এবং রক্ষণাবেক্ষণের খরচ জেলা পরিষদকে দেয় জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। কিন্তু তারা সে টাকা না দেওয়ায় জেলা পরিষদের অধীন প্রকল্পের পাম্প অপারেটরদের বেতন বন্ধ গত অগস্ট মাস থেকে। রক্ষণাবেক্ষণও শিকেয় উঠেছে।
এই পরিস্থিতির ফলে জল সরবরাহে সমস্যাও শুরু হয়েছে নানা জায়গায়। দিনকয়েক আগেই বাগনান ১ পঞ্চায়েত সমিতি এলাকাতে জল প্রকল্পের পাম্প খারাপ হওয়ায় দুর্ভোগ হয় এলাকার হাজার খানেক বাসিন্দার। হাওড়া জেলা পরিষদের পূর্ত কর্মাধ্যক্ষ আনন্দ চট্টোপাধ্যায় বলেন, “২০১১-র নভেম্বর মাসে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর থেকে আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়, জেলার সব জল প্রকল্পের দায়িত্ব যেন আমরা এবং পঞ্চায়েত সমিতিগুলি গ্রহণ করি। কিন্তু জেলার ১৪টি পঞ্চায়েত সমিতি জানিয়ে দেয়, জলপ্রকল্পের দায়িত্ব তারা নিতে পারবে না। সে কথা আমরা দফতরকে জানিয়ে দিয়েছি।”
বাগনান ১ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অপূর্ব চক্রবর্তী বলেন, “পাম্প অপারেটরদের বেতন, রক্ষণাবেক্ষণের খরচ জোগাবো কোথা থেকে? জলকর বসানোর অনুমতিও তো সরকার দিচ্ছে না।” আনন্দবাবুর বক্তব্য, “জলকর বসাতে গেলে বাড়ি-বাড়ি জলের সংযোগ দিতে হবে। এ বিষয়েও এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট নীতি তৈরি করেনি রাজ্য সরকার। তাই সমস্যা হচ্ছে।”
যে সব জল প্রকল্পে কেন্দ্র টাকা দিয়েছে, গত কয়েক বছর ধরে সে সব প্রকল্পের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের শর্ত হচ্ছে, রাস্তার ধারে যে ‘স্ট্যান্ড পোস্ট’ বসানো হবে সেখান থেকে জল নিতে হলেও বাসিন্দাদের জলকর দিতে হবে। বামফ্রন্ট সরকার এই নীতি মানেনি। বাম-জমানায় জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “কেন্দ্রকে বলেছিলাম, প্রকল্পগুলি এমন ভাবে করা হোক যাতে অন্তত ৫০ শতাংশ বাড়িতে সরাসরি জলের সংযোগ দেওয়া যায়। কেন্দ্র আমাদের সেই সূত্র মেনে নিয়েছিল।” সেই সূত্র মেনে কাজ হল না কেন? গৌতমবাবুর জবাব, “কাজটা আমরা শুরু করেছিলাম। নতুন সরকারের আমলে কী হয়েছে, বলতে পারব না।”
জনস্বাস্থ্য কারিগরিমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, “জলপ্রকল্প চালু রাখা এবং রক্ষণাবেক্ষণ খাতে ঠিকাদারদের বড়জোর মাসখানেকের টাকা বাকি রয়েছে। জেলা পরিষদের ক্ষেত্রে কোনও টাকা বাকি নেই।” |