পশ্চিমবঙ্গে দু’-দু’টো ফিল্ম সিটি হচ্ছে বলে ফের প্রত্যয়ী ঘোষণা শোনা গিয়েছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে। শিল্পের দৌড়ে রাজ্যের অগ্রগতির খতিয়ান দিতে গিয়ে হলদিয়ায় বেঙ্গল লিডস-এর উদ্বোধনী মঞ্চ থেকে এ কথা জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু বাস্তবের সঙ্গে সেই প্রত্যয়ের আকাশ-পাতাল ফারাক। বছর ঘুরতে চলল, এখনও ‘হচ্ছে হবে’-তেই আটকে রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর সাধের দুই ফিল্ম সিটি।
এবং ছবিটা যেমন উত্তরপাড়ায়, তেমনই শিলিগুড়িতে। উত্তরপাড়ায় জমির সমস্যা প্রথম থেকেই ছিল। তার উপরে নদীর ভাঙনের কোপে প্রকল্পের ভবিষ্যৎ ক্রমশ অনিশ্চিতের গর্ভে চলে যাচ্ছে। আর শিলিগুড়িতে জমির বেশ কিছুটা এখনও অন্যের হাতে। তা ফেরত পাওয়া নিশ্চিত হলেই কাজ শুরু হবে। তবে তার দিনক্ষণ কারও জানা নেই। উত্তরপাড়ায় গঙ্গার তীরে ফিল্ম সিটির জন্য চিহ্নিত কলকাতা পুরসভার জমিটিতে দখলদারির গ্রাস অনেক দিন ধরেই। দখলদার ইটভাটাগুলোকে সরানো যায়নি। সরানো যাবে, তেমন আশু নিশ্চয়তাও মিলছে না। সঙ্গে জুড়েছে গঙ্গার ভাঙন। তার কোপে জমির পাড় ক্ষয়ে কিছু ইটভাটার অংশও বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদীর অতলে। এমনকী, লাগোয়া শিবতলা শ্মশানও বাদ যাচ্ছে না। এক ভাটার ম্যানেজার সুনীল রাউতের কথায়, “এখানে রয়েছি পঞ্চাশ বছর। এমন ভাঙন দেখিনি। এক বছরের বেশি আমাদের ভাটা বন্ধ।” এ অবস্থায় ওখানে প্রকল্পের কাজ হবে কী করে? |
প্রশাসন অবশ্য ভীত নয়। এক কর্তা বলেন, “ভাঙনের ব্যাপারটা আমাদের মাথায় আছে। অবৈধ ভাবে গঙ্গার বালি তোলায় সমস্যা বেড়েছে।” যথেচ্ছ গঙ্গার বালি তোলা রুখতে সরকার কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলে জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু ভাঙন ঠেকানো গেলেও ফিল্ম সিটি রূপায়িত করতে গিয়ে এখানেও জমির দখল পেতে বেগ পেতে হতে পারে রাজ্য সরকারকে। এলাকায় গিয়ে তেমনই ইঙ্গিত মিলেছে। কী রকম?
বিকল্প রুজি-বাসস্থান না-পেলে ভাটা-কর্মীরা জমি ছাড়বেন না। শান্তি তাঁতির কথায় তারই আভাস। বিহারের মোকামার বাসিন্দা ওই মহিলা বলছেন, “স্বামী-মেয়ে নিয়ে এত দিনের বাস। সরকার উঠে যেতে বললেই যাব কেন? আগে আমাদের রুজি-বাড়ির ব্যবস্থা হোক।” ওঁদের দাবির পালে রাজনীতির হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। স্থানীয় সিপিএম নেতৃত্ব ইতিমধ্যে মিছিল করে থানায় গিয়ে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন। “ফিল্ম সিটির জমিতে থাকা ইটভাটাগুলো অন্তত এক হাজার শ্রমিকের রুজি-রুটির ঠিকানা। সরকারকে নির্দিষ্ট কিছু পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতেই হবে। না-হলে আমরা আন্দোলনে নামব।” হুঁশিয়ারি দিচ্ছেন উত্তরপাড়া সিপিএমের শ্রমিক নেতা শঙ্কর মুখোপাধ্যায়।
ফলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। প্রকল্পের জমি কাঁটা-তারে ঘেরার লক্ষ্যে বার বার দরপত্র আহ্বানের তোড়জোড় করেও শেষ পর্যন্ত করা যায়নি। উত্তরপাড়া পুরসভা ব্যর্থ হওয়ায় ওই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনকে। সিদ্ধান্ত হয়েছে, কাঁটাতারের বদলে করোগেটেড টিনে জমি ঘেরা হবে, যে বাবদ খরচ ধরা হয়েছে প্রায় ৮০ লক্ষ টাকা। দখল উচ্ছেদ না-হলে কাজটা হবে কী করে?
রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, “জমিটা সরকারের। ইটভাটাগুলো মামলায় হেরে গিয়েছে। কর্মচ্যুত শ্রমিকদের কিছু ক্ষতিপূরণ নিশ্চয় দেওয়া হবে।” আদতে জমিটি যাদের, সেই কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ও বলেন, “ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন নিয়ে আলোচনা চলছে।” যদিও উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হবে, সে সম্পর্কে প্রশাসনেরই একটি মহল কিছুটা সন্দিহান। “দোকানপাটের মালিকদের পুনর্বাসন দেওয়া যায়। বারো-চোদ্দোটা ইটভাটার ক্ষেত্রে তা কতটা সম্ভব? অত জমি কোথায়?” প্রশ্ন তুলছেন ওঁরা।
অর্থাৎ, ঘুরে-ফিরে সেই জমির জট। তার ফাঁসে আটকে রয়েছে শিলিগুড়ির ফিল্ম সিটিও। শিলিগুড়ির উপকণ্ঠে মহানন্দা ও বালাসনের সংযোগস্থলে কাওয়াখালিতে ৭৫ একর জুড়ে প্রকল্পটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা হয়ে থাকলেও কাজ শুরু হয়নি। কারণ, জমির পুরোটা এখনও সরকারের হাতে আসেনি। শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি উন্নয়ন পর্ষদ (এসজেডিএ) জমিটি অধিগ্রহণ করেছিল বাম আমলে। সেখানে উপনগরী তৈরির জন্য একটি সংস্থার সঙ্গে সমঝোতাপত্রও সই হয়ে যায়। রাজ্যের তদানীন্তন পুর-নগরোন্নয়নমন্ত্রী তথা এসজেডিএ-র তৎকালীন চেয়ারম্যান অশোক ভট্টাচার্য জানান, সংস্থাটি আগাম হিসেবে বেশ কিছু টাকা টাকা এসজেডিএ-কে দিয়েছিল, যা পর্ষদের কাছে রয়েছে। এখন ভাবা হচ্ছে, ওই অর্থ-মূল্যের জমি ইউনিটেক-কে দেওয়া যায় কি না। এসজেডিএ ফিল্ম সিটির জন্য জমি চিহ্নিত করলেও সংস্থাটির সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনার পরেই কাজ শুরু হবে। সেটা কবে?
এসজেডিএ-র বর্তমান চেয়ারম্যান রুদ্রনাথ ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, জমিতে পাঁচিল তোলার কাজ শেষের মুখে। সংস্থাটির সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। সরকারি সূত্রের খবর: প্রায় তিনশো কোটি টাকার প্রকল্পটির জন্য অর্থের সংস্থান করাটাও বড় ব্যাপার। দেখা হচ্ছে, কাদের সঙ্গে এবং কী ভাবে চুক্তি করে তা রূপায়িত করা যায়। এ জন্য সরকার টেন্ডার ডাকবে। অর্থাৎ, এরও ভাগ্য ভবিষ্যতের গর্ভে।
|
(প্রতিবেদন: সঞ্জয় চক্রবর্তী, গৌতম বন্দ্যোপাধ্যায় ও কিশোর সাহা) |