দু’মাসে দু’শো মাইল উজিয়ে ফিরল মেনি
‘শিব্রাম চকরবরতি’ কতটা অবাক হতেন, বলা যাচ্ছে না। তবে দুনিয়ার বেড়ালপ্রেমীরা তাজ্জব তার কাণ্ডে। নাম হলি। আমেরিকার এই পুষ্যি বেড়াল বেড়াতে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছিল। ফ্লোরিডার ডেটোনা বিচে উধাও হওয়ার দু’মাস বাদে ২০০ মাইল উজিয়ে পথ চিনে কী ভাবে ‘আবার সে এসেছে ফিরিয়া’!
চার বছরের বাদামি-কালো চকরাবকরা মেনির ছাল-চামড়া ওঠা দগদগে থাবার দশা দেখে তার মানুষ-মায়ের চোখে জল। ওয়েস্ট পাম বিচের ৬৩ বছরের অবসরপ্রাপ্ত নার্স বনি রিখটার এক সাংবাদিককে বলেছেন, “এতটা পথ হেঁটে আসতে খুকি আমার বড়ই কাহিল। হলিসোনার দিকে তাকানো যাচ্ছে না!” সাড়ে তেরো পাউন্ড থেকে ঝরে সাত পাউন্ড হয়ে গিয়েছে শ্রীমতি হলি।
শিব্রামের গল্পের বিল্লিটিকে অবশ্য এতটা দুর্ভোগ পোহাতে হয়নি।
তবে শিক্ষে হয়েছিল, দু’ভাই হর্ষবর্ধন-গোবর্ধনের। বেড়ালের জ্বালায় অস্থির হয়ে ‘ছাড়ালে না ছাড়ে, কী করিব তারে’ ভেবে তাকে বিদেয় করতে বেরিয়ে বাড়ি ফিরতে শেষটা বেড়ালেরই শরণাপন্ন হতে হল।
বেড়াল পার করার সন্তোষজনক জায়গার খোঁজে দক্ষিণ থেকে উত্তর কলকাতা ঘুরে হাওড়ার গলিঘুঁজিতে ঢুকে দু’ভাই নিজেরাই পথ হারিয়ে ফেললে! অগত্যা বস্তার মুখ খুলে বেড়ালটিকে ছেড়ে দিতে হল। দিশেহারা দু’ভাইকে সেই বেড়ালই এ বার বাড়ি পর্যন্ত পথ চিনিয়ে নিয়ে চলে।
অঙ্কন: সুমন চৌধুরী
গন্ধে-গন্ধে দূর-দূরান্ত থেকে পথ চিনে পুষ্যি বেড়ালের প্রত্যাবর্তনের প্রতিভা নিয়ে চর্চা বহুদিনের। তবু ২০০ মাইল নেহাতই চাট্টিখানি কথা নয়! জনপ্রিয় টিভি শো ‘মাই ক্যাট ফ্রম হেল’-এর সঞ্চালক জ্যাকসন গ্যালাক্সি তাঁর নিজের পুষ্যি র্যাবির গুণপনায় সদাই মুগ্ধ। র্যাবিও একবার পাশের শহরে বেড়াতে গিয়ে চম্পট দিয়েছিল। দিন দশেক বাদে নিজেই সটান বাড়ি ফিরে আসে। কিন্তু সে তো মোটে পাঁচ মাইল রাস্তা! “হলির মতো কীর্তি আগে কখনও শুনিনি!” সসম্ভ্রমে বলছেন গ্যালাক্সি।
তবে সাইবেরিয়ার পাখিরা তো এখনও বাঁধা-ধরা সময়ে কলকাতায় শীতটা কাটাতে আসে! পরিযায়ী মনার্ক প্রজাপতির অনায়াসে কানাডা থেকে মেক্সিকো পাড়ির দুঃসাহসও অক্ষয় কীর্তি! “তাহলে বেড়ালের বেলায় অত অবাক হওয়ার কী আছে!” বলছেন, প্রাণীবিদ্যার অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক তথা জীবজন্তুর ভাবগতিক নিয়ে গবেষণারত পুলক লাহিড়ি।
পুলকবাবু অবশ্য বেড়াল নিয়ে তত হাতে-কলমে পরীক্ষা করেননি। কিন্তু পায়রার রকম-সকম তাঁর জানা। পুলকবাবুর দাবি, “পায়রাকে চোখ-মুখ ঢেকে পটনা কি দিল্লি নিয়ে যান! দেখবেন, ছেড়ে দিলে ওরা ফের কলকাতায় উড়ে এসেছে।”
পায়রা পারলে বেড়াল পারবে না কেন?
নারীচরিত্রের মতো প্রাণিকুলে বেড়ালকে বোঝাও যে অত সোজা কাজ নয়, তা কিন্তু গুণিজনেরা অনেকেই স্বীকার করেছেন। বেড়ালের গভীর অনুরাগী লীলা মজুমদারই বলেছেন, দুনিয়ার কোনও দুই বেড়ালে সহজে মিল হয় না। এবং লীলার পর্যবেক্ষণ, শুধু মানুষই যে বেড়ালকে পোষে তা তো নয়। বেড়ালরাও মানুষকে পোষে।
এটা যে বিলক্ষণ সত্যি, তা হলিকে ফিরে পেয়ে তার ‘মা-বাবা’ বনি ও জ্যাকব রিখটারের আবেগে থরথর দশা দেখেই মালুম হচ্ছে। রাজ্যের বিধায়ক তথা অভিনেত্রী দেবশ্রী রায়ের চোখে, “এই ফিরে আসা ভালবাসার জয়।” দেবশ্রী নিজেও তাঁর ছোট্ট মিনিকে চক্ষে হারান। কুকুর, বেড়াল-অন্তপ্রাণ দেবশ্রীর অভিজ্ঞতায়, ভালবাসা পেলে বেড়াল বা কুকুর কিন্তু এমন অসাধ্যসাধন করতেই পারে। “আমার চেনা একটা কুকুর মুকুন্দপুর থেকে হেঁটে-হেঁটে বজবজে তার মালকিনের কাছে ফিরে গিয়েছিল।”
বিজ্ঞানীদের অনেকেরই আফশোস, পাখি, কচ্ছপ বা কীটপতঙ্গের বেলায় যত গবেষণা হয়েছে, বেড়াল নিয়ে তত কাজ হল কই! ব্রিটিশ বেড়াল বিশেষজ্ঞ রজার ট্যাবরের কাছে ৬০ বছর আগে জার্মানির একটি গবেষণার ফল কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ। একটি খোপ-কাটা গোলাকার ঢাকনিতে এক দল বেড়ালকে ছেড়ে দিয়ে দেখা গিয়েছিল, তারা প্রত্যেকেই নিখুঁত আন্দাজে নিজের বাড়ির দিকের খোপটা ধরেই বেরিয়েছিল।
ট্যাবরের ঝুলিতে হলির মতো কীর্তিমান বেড়ালের আখ্যানও রয়েছে গোটাকতক। ১৯৮৯-তে রাশিয়ার ডোরা-কাটা মুরকা ৩২৫ মাইল পেরিয়ে একা-একা মস্কোয় ফিরে এসেছিল। আর ৩৪ বছর আগে অস্ট্রেলিয়ার ‘পশমের পুঁটলি’ হাউয়ি না কি হারিয়ে গিয়েও ঘরে ফিরতে ১০০০ মাইল পথ অতিক্রম করে।
আমেরিকার হলির ২০০ মাইল ডিঙোনোর কীর্তি তবু খাটো চোখে দেখছেন না কেউই। কিন্তু ঘরের মেয়ে ফিরে আসার পরে অহেতুক বিতর্কে রুচি নেই তার ‘মা-বাপে’র। সেই নভেম্বরে ফ্লোরিডায় ‘সপরিবার’ বেড়াতে যাওয়ার পর থেকে এতদিন কোথায় ছিল হলি? ডেটোনায় মোটর র্যালি দেখতে গিয়ে একদিন রাতে তাদের ক্যাম্পের দরজা খোলা পেয়ে সে বেরিয়ে গিয়েছিল। নিজেদের বাড়ি ফিরতে গোটা রাস্তাই কি সে হেঁটে এল? না কী পথচলতি কোনও গাড়ি বা ট্রাকে ‘লিফ্ট’ নিয়েছিল—এ সব কূট প্রশ্নে মাথা ঘামাতে রাজি নন রিখটার দম্পতি। রিখটারদের বাড়ির কাছেই এক উঠোনে দুধ-ভাতের গন্ধে ক্নান্ত-বিধ্বস্ত মেনিটি উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। সেখানে ঠাঁই মেলার পরে তার গায়ে-সাঁটা মাইক্রোচিপটি থেকেই ঠিকুজি-কুষ্ঠির হদিস মেলে। বেটি ফিরে এসেছে এটাই বড় কথা! মধুরেণ সমাপয়েতে বলছেন, গদগদ মা-বাবা। কে জানে! হযবরল-র কায়দায় তখন এক চোখ মটকে হয়তো হাসছে হলি!


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.