নেত্রী না মানুন, ত্রিফলায় অনিয়ম মানলেন মেয়র
ত্রিফলা-যজ্ঞে অনিয়মের কথা কার্যত স্বীকার করে নিলেন কলকাতার মেয়র। পুরসভার নিজস্ব অডিটের চূড়ান্ত রিপোর্ট এবং মুখ্য অডিটরের মতামত হাতে পেয়ে তিনি জানালেন, এ ব্যাপারে এ বার ব্যবস্থা গ্রহণের পালা শুরু হবে।
ক’দিন আগে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রবীন্দ্র সরোবরে এক অনুষ্ঠানে দাবি করেছিলেন, ত্রিফলা আলো বসাতে গিয়ে অনিয়ম কিছু হয়নি। বস্তুত তাঁরই নির্দেশে ত্রিফলার বরাত ভাগ ভাগ করে দেওয়া হয়েছে বলে ঘোষণা করে মমতা সে দিন যুক্তি দেন, একটা বড় কাজ কারও একার পক্ষে করতে অনেক সময় লাগে বলেই তাঁর ওই সিদ্ধান্ত। কিন্তু পুর-আধিকারিকেরা হিসেব কষে দেখেছিলেন, বিধি-ভাঙা বরাতের মাসুল গুনতে গিয়েই ত্রিফলা আলোর পিছনে কলকাতা পুরসভার কোষাগার থেকে অন্তত ১৩ কোটি টাকা বাড়তি বেরিয়ে গিয়েছে, নিয়ম মানলে যা বাঁচানো যেতে পারত।
অনিয়মের সেই অভিযোগের প্রতিধ্বনি মিলেছিল পুরসভার অভ্যন্তরীণ অডিট-রিপোর্টে। অডিটের খসড়া রিপোর্ট পেয়ে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, চূড়ান্ত রিপোর্ট হাতে পেলে যথোচিত পদক্ষেপ করবেন। পুরসভার মুখ্য অডিটরকে রিপোর্টটি পর্যালোচনা করতে বলা হয়েছিল। মুখ্য অডিটর বিপ্লব গুহরায় মঙ্গলবার তাঁর মতামত পুর-কমিশনারকে জানিয়ে দিয়েছেন। ত্রিফলা নিয়ে পুরসভার নানা অনিয়মে যাচাইয়ের সিলমোহর লাগিয়ে তিনি বলেছেন, অডিটের রিপোর্টে ভুল কিছু নেই। যার পরিপ্রেক্ষিতে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় এ দিন বলেন, “ত্রিফলা-কাণ্ডে অনিয়মের কথা জানিয়েছে অডিট-রিপোর্ট। পুরসভার মুখ্য অডিটরের বক্তব্যও তা-ই। এ বার ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হবে।”
যুক্তিহীন তেরো কোটি
বাতিস্তম্ভ   বাতি-ব্র্যাকেট
• শহরকে পাঁচ অঞ্চলে বিভাজন
• একই ঠিকাদারকে একাধিক অঞ্চলে বরাত
• মোট ১৩টি বরাত একই সংস্থাকে
• একই জিনিস ভিন্ন ভিন্ন দরে
•অযৌক্তিক ব্যয় প্রায় ১০ কোটি
• নামী সংস্থার দর সেটপিছু ২০০০ টাকা
• সেটপিছু ২৩৭৫ টাকা দর অনামী সংস্থার
• চব্বিশ ঘণ্টায় সেই দর বেড়ে ২৯৬৯ টাকা
• তাতেই ৬০ হাজার সেট খরিদ
• অযৌক্তিক ব্যয় অন্তত সাড়ে ৩ কোটি

*
২০ হাজার ত্রিফলার হিসেব
কলকাতার রাজপথে ত্রিফলা (ট্রাইড্যান্ট) আলোর প্রয়োজন আদৌ ছিল কি না, সে প্রশ্ন গোড়া থেকে মাথা চাড়া দিয়েছে। ত্রিফলা জ্বালাতে বিদ্যুৎ-বিল বাবদ বেশ কয়েক কোটি টাকার বাড়তি বোঝা চেপেছে পুরসভার ঘাড়ে, যা নিয়েও পুর-অডিটে প্রশ্ন উঠেছে। তাতে কর্ণপাত না-করে কলকাতা জুড়ে ত্রিফলা আলো লাগানো হয়েছে।
এরই মধ্যে পুরসভার নিজস্ব অডিটে ত্রিফলায় আরও গরমিল ধরা পড়ায় ব্যাপারটা গুরুতর মাত্রা পেয়েছে। অডিট দেখেছে, একই ঠিকাদারকে একই বাতিস্তম্ভ হরেক জায়গায় হরেক দরে বসানোর ঢালাও বরাত দিয়েছেন পুর-কর্তৃপক্ষ। একই এলাকায় একই সংখ্যক বাতিস্তম্ভ লাগাতে সংস্থাটি কোথাও চেয়েছে তিন লক্ষ, কোথাও তিন লক্ষ নব্বই হাজার, কোথাও বা চার লক্ষ। পুরসভা তা মেনেও নিয়েছে! পাশাপাশি ত্রিফলা-স্তম্ভের সিএফএল বাতি ও আনুষঙ্গিক ব্র্যাকেটের জন্য বাজারের নামী সংস্থা যে দাম রেখেছিল, সেই জিনিসই অনামী ও অননুমোদিত সংস্থার কাছ থেকে কেনা হয়েছে সেটপিছু হাজার টাকা বেশি দিয়ে! শুধু তা-ই নয়, অনামী সংস্থাটি তাদের প্রাথমিক দর রাতারাতি প্রায় ছ’শো টাকা বাড়িয়ে দেওয়া সত্ত্বেও কোনও প্রশ্ন না-ওঠায় বিস্ময়ের সৃষ্টি হয়েছে পুরভবনের অন্দরে। এবং এই দুই ‘অনিয়ম’ ঠেকাতে পারলে ত্রিফলা খাতে পুর-ভাঁড়ারে অন্তত তেরো কোটির সাশ্রয় হতো বলে হিসেব কষে দেখেছেন অর্থ-আধিকারিকেরা। পুর-অডিট রিপোর্টেও তাঁদের পর্যবেক্ষণ সমর্থিত। অডিটের মূল রিপোর্টটি তিরিশ পাতার। সঙ্গে রয়েছে ১৫৬ পাতা নথি। তাতে আরও কিছু বিষয়ে সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে। কী রকম?
রিপোর্ট মোতাবেক, বেশ কিছু ক্ষেত্রে বরাত পাওয়ার এক দিনের মধ্যে কাজ শেষ করে ফেলেছেন ঠিকাদার, যা ঘোরতর অস্বাভাবিক। অডিটরদের মতে, ঠিকাদার যতই যোগ্য হোন, কিংবা তাঁর কাজের পরিকাঠামো যতই ভাল হোক, এক দিনে কাজ সেরে ফেলাটা কার্যত অসম্ভব। আবার ওয়ার্ক অর্ডার বার হওয়ার আগে ‘আর্নেস্ট মানি’ জমা দেওয়ার নিয়ম থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে কিছু সংস্থা তা জমা করেছে বরাতলাভের ছ’মাস, এমনকী দশ মাস পরে! উপরন্তু অডিটের প্রশ্ন, পুরসভার এন্টালি ওয়ার্কশপে ত্রিফলা তৈরি হল না কেন?

পুরসভা যা করেছে, ঠিক করেছে! আমিই বলেছিলাম, কাজগুলো ভাগ ভাগ করে দিতে। অত লোকলস্কর জোগাড় করা এক জনের পক্ষে সম্ভব নয়।
১২ ডিসেম্বর ২০১২
ত্রিফলা-কাণ্ডে অনিয়মের কথা জানিয়েছে অডিট-রিপোর্ট। পুরসভার মুখ্য অডিটরের বক্তব্যও তা-ই। এ বার ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হবে।
২২ জানুয়ারি ২০১৩

ঘটনা হল, এই প্রস্তাবে ওয়ার্কশপের যে সম্মতি ছিল, পুর-নথিতেই তার প্রমাণ স্পষ্ট। কিন্তু পুরসভার আলো দফতরের দাবি: এত কম সময়ের মধ্যে এন্টালি ওয়ার্কশপ এত সংখ্যক বাতিস্তম্ভ সরবরাহ করতে পারত না। অডিটের কাছে অবশ্য এই ব্যাখ্যা গুরুত্ব পায়নি। বরং পুর-নথি উদ্ধৃত করে রিপোর্টের বক্তব্য: আলো বিভাগই চায়নি যে, এন্টালি ওয়ার্কশপকে দায়িত্বটা দেওয়া হোক। রিপোর্ট বলছে, ঠিকঠাক পরিকল্পনা না-করে যত্রতত্র ত্রিফলা বসানো হয়েছে। যে বেহিসেবের খেসারত দিতে গিয়ে বিস্তর বেড়েছে বিদ্যুতের খরচ। অডিট-রিপোর্ট অনুযায়ী, আগে পুরসভাকে মাসে ১৩ কোটি টাকা বিদ্যুৎ-বিল মেটাতে হতো, ত্রিফলার জেরে তা বেড়ে ২১ কোটি টাকা হয়েছে। এটা অবশ্য আগের হিসেব। এখন মাসিক বিদ্যুৎ-বিলের গড় অঙ্কটা তিরিশ কোটি ছুঁয়েছে বলে জানিয়েছেন এক পদস্থ পুর-আধিকারিক।
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.