মাস কয়েক আগে নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের তথ্য দেখে চমকে উঠেছিলেন পার্ক সার্কাসের এক বাসিন্দা। ব্যাঙ্কে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, হায়দরাবাদের একটি এটিএম থেকে তাঁর ডেবিট কার্ড ব্যবহার করে ৩০ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। এর পরেই লালবাজারের ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখার দ্বারস্থ হন তিনি।
গোয়েন্দারা বলছেন, শুধু পার্ক সার্কাসের ওই বাসিন্দাই নন, এ ভাবে অনেকেরই কার্ডের হুবহু নকল তৈরি করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে দুষ্কৃতীরা। প্রযুক্তির ভাষায় এই কায়দাকে বলা হয়, ‘কার্ড স্কিমিং’। অর্থাৎ গ্রাহকের অজ্ঞাতেই তাঁর কার্ডের তথ্য চুরি করে ‘ডুপ্লিকেট কার্ড’ তৈরি করা এবং তা দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। আড়াই বছর আগে কলকাতা থেকেই এই চক্রের পাঁচ জনকে গ্রেফতার করেছিলেন ব্যাঙ্ক জালিয়াতি দমন শাখার অফিসারেরা। তার পরে মাস দুয়েক আগে একই অভিযোগে ফের ধরা পড়েছেন জ্যাব্রিয়েল মার্টিন নামে এক নাইজেরীয়-সহ তিন জন। উদ্ধার হয়েছে কার্ড জালিয়াতির যন্ত্র ও ‘ব্ল্যাঙ্ক’ কার্ড।
কী ভাবে করা হয় স্কিমিং?
পুলিশ সূত্রের খবর, রেস্তোরাঁ বা দোকানে ক্রেডিট কার্ড বা ডেবিট কার্ড দিয়ে কেনাকাটার সময়ে একটি বিশেষ যন্ত্রে তা ঘষা (‘সোয়াইপ’) হয়। এর ফলে সঙ্গে সঙ্গে সেই তথ্য চলে যায় বিদেশে বসে থাকা জালিয়াতি চক্রের চাঁইদের কাছে। সেই তথ্য ব্যবহার করে কম্পিউটারের মাধ্যমে ‘ডুপ্লিকেট’ কার্ড তৈরি করা হয়। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, চিন, তাইওয়ান, বাংলাদেশ-সহ এশিয়ার নানা দেশ থেকে ‘ব্ল্যাঙ্ক কার্ড’ কিনে নেওয়া হয়। তার পরে সেই কার্ডটির সামনে নাম ও অ্যাকাউন্ট নম্বর ছাপানো হয়। ভিতরে আসল কার্ড গ্রাহকের তথ্য ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। তৈরি হয় জাল কার্ড। এ ছাড়াও, ইন্টারনেটে বেশ কিছু ভুয়ো সাইট রয়েছে। |
সতর্ক থাকুন |
ক্রেডিট কার্ড |
• দু’টির বেশি ব্যবহার করবেন না
• অপরিচিতের হাতে দেবেন না
• কাউকে কার্ডের তথ্য জানাবেন না
• অনলাইনে কার্ড ব্যবহারে সতর্ক থাকুন
• হারালে সঙ্গে সঙ্গে অভিযোগ জানান |
ডেবিট কার্ড |
• প্রহরাহীন এটিএম এড়িয়ে চলুন।
• মোবাইলে এসএমএস-এর ব্যবস্থা করুন।
• পিন লিখে রাখবেন না।
• হারালে সঙ্গে সঙ্গে জানান।
• নিজের অ্যাকাউন্টে নজর রাখুন। |
|
যেখানে সস্তায় কেনাকাটার টোপ দিয়ে ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডের নম্বর ও পিন হাতিয়ে নেয় দুষ্কৃতীরা।
পুলিশ বলছে, নেট-জালিয়াতির ক্ষেত্রে ইন্টারনেট বা ই-মেল আইডি-তে বেশ কিছু সূত্র পান তদন্তকারীরা। কিন্তু ‘স্কিমিংয়ের’ ঘটনায় সূত্র বলতে জাল কার্ড ব্যবহার করে একমাত্র যে জায়গা থেকে টাকা তোলা হয়েছে, তার হদিস। ফলে এই ধরনের অপরাধীদের ধরতে নাজেহাল হয় পুলিশ। গোয়েন্দারা জেনেছেন, কলকাতায় যে সব জাল কার্ড ব্যবহার করা হয়, তার অধিকাংশই বিদেশের। আবার এ রাজ্যের কার্ড জাল করে ব্যবহার করা হয় বিদেশের কোনও শহরে। ফলে অনেক সময়েই চট করে অপরাধীদের হদিস মেলে না।
পুলিশ সূত্রের খবর, জ্যাব্রিয়েলকে ধরার আগে ২০১০ সালের মার্চ মাসে বিমানবন্দর থেকে পিটার ওরেনুবি ও বেনসন অ্যাডামস নামে দুই নাইজেরীয়কে গ্রেফতার করেন ব্যাঙ্ক জালিয়াতি শাখার অফিসারেরা। ধরা পড়ে পিটারের ভারতীয় স্ত্রী লিয়ানা জোয়ার্ডসন, অঙ্কিত সাউ ও মণীশ অগ্রবাল নামে দুই যুবকও। এই দু’জন ওই চক্রের স্থানীয় এজেন্ট হিসেবে কাজ করত। সে বারই প্রথম কার্ড জালিয়াতির কথা জানতে পারে পুলিশ।
কী ভাবে কাজ করে এই ধরনের চক্র? পুলিশ জানায়, কার্ড জালিয়াতি চক্রের মাথারা ছাত্র বা খেলোয়াড় পরিচয়ে রাজ্যে ঢোকে। তার পরে এলাকার বেশ কিছু বেকার ছেলেকে এজেন্ট হিসেবে নিয়োগ করে। বিভিন্ন ছোটখাটো দোকানের কর্মীদেরও টাকার লোভ দেখিয়ে এই কাজে নিয়ে আসা হয়। তারাই কার্ডের তথ্য চুরি করে।
পুলিশ সূত্রের খবর, ছোটখাটো দোকানের কর্মীরা গ্রাহকদের অগোচরেই তাঁদের কার্ড ওই বিশেষ যন্ত্রে ঘষে তথ্য হাতায়। বেকার যুবকেরা কমিশনের লোভে জাল কার্ড দিয়ে কেনাকাটা বা টাকা তোলার কাজটি করে।
গোয়েন্দারা জানান, শহরে বসে ভিন্দেশি জালিয়াতেরা যেমন বিদেশি নাগরিকদের কার্ড জাল করছে, তেমনই এ রাজ্যের নাগরিকদের তথ্যও চুরি হচ্ছে। কলকাতা ছাড়াও দিল্লি, মুম্বই, বেঙ্গালুরুতেও এই ঘটনা ঘটছে বলে লালবাজারের এক কর্তা জানিয়েছেন।
পুলিশ সূত্রের খবর, কলকাতায় এই ধরনের অভিযোগ গত দু’বছরে পাঁচটি পেয়েছে লালবাজার। তবে গোয়েন্দারা জানান, অভিযোগ জমা পড়ছে রাজ্য পুলিশের কাছেও। সিআইডির এক কর্তা বলেন, “সাম্প্রতিক কালে কয়েকটি এ ধরনের অভিযোগ মিলেছে।”
স্কিমিং ঠেকাতে এখনও কোনও প্রযুক্তির হদিস দিতে পারেনি ব্যাঙ্কগুলি। তবে ঘটনার উপর নিয়মিত নজর রাখা হয় বলে দাবি ব্যাঙ্ককর্তাদের। দেশের প্রথম সারির একটি বেসরকারি ব্যাঙ্ক সূত্রের খবর, ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডে সন্দেহজনক লেনদেন নজরে এলেই মনিটরিং সেল থেকে সংশ্লিষ্ট গ্রাহককে যোগাযোগ করা হয়। যদি দেখা যায়, ওই লেনদেন তাঁর অজ্ঞাতে হয়েছে, তা হলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে ব্যাঙ্কগুলিকেও যেমন ক্ষতিপূরণ দিতে হয়, আবার সংশ্লিষ্ট গ্রাহক বা দোকান মালিকও (যে দোকান থেকে কার্ড ব্যবহার করে জিনিস কেনা হয়েছে) ক্ষতিগ্রস্ত হন। একটি বেসরকারি ব্যাঙ্কের মুখপাত্র জানান, “কে ক্ষতিপূরণ দেবেন, তা নিয়মাবলী অনুযায়ী ঠিক করা হয়। এটিএম থেকে টাকা তোলা হলে ব্যাঙ্কের দায় থাকে না।” কারণ, এটিএম কার্ডের পিন নম্বরের সুরক্ষা গ্রাহকের বলে দাবি করেছেন ওই মুখপাত্র।
|