|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
শিল্পীর ঝোঁক চেতনা ও সৌন্দর্যের অলিখিত মুক্তিতে |
সম্প্রতি স্টুডিও ২১-এ অনুষ্ঠিত হল চন্দ্রিমা রায়ের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
একেবারে সূচনা পর্ব থেকেই আমাদের চিত্রকলার আধুনিকতায় স্বদেশ ও বিশ্বের একটা সমন্বয়-প্রক্রিয়া চলেছে। কখনও কখনও এই দুইয়ের মধ্যে দ্বান্দ্বিক পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছে। মনে করা হয়েছে শিল্পের স্বদেশ একটি ভ্রান্ত ধারণা। শিল্পপ্রকাশের কোনও জাতিগত বা ভৌগোলিক সীমারেখা নেই। এই দু’টি ভাবনার মধ্যে আন্দোলিত হতে হতে চিত্রকলার আধুনিকতা ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ থেকে একবিংশ শতক পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে। এর মধ্যে বিংশ শতকের প্রথম দু’ তিনটি দশক জুড়ে শিল্পের স্বদেশ সন্ধানে একটি সর্বাঙ্গীণ আন্দোলন বিস্তৃত হয়েছিল। এ রকম সংঘবদ্ধ এবং বিকেন্দ্রিত আঙ্গিক-নির্ভর আন্দোলন পরবর্তী কালে আর হয়নি। বিংশ শতকের তৃতীয় দশক থেকে আধুনিকতার বিস্তার ঘটেছে দু’ ভাবে। শিল্পের স্বদেশ-ভাবনাকে অনুসরণ করেছেন কেউ কেউ। নানা ভাবে একে প্রসারিত করতে চেষ্টা করেছেন। কেউ বা এই প্রত্যয়কে সংকীর্ণ ভেবে শিল্পকে বিশ্বায়ত করতে চেষ্টা করেছেন। তা সত্ত্বেও এই একবিংশ শতকের বিশ্বায়নের পরিস্থিতিতেও শিল্পের স্বদেশ ভাবনা অনেকের কাছেই প্রাসঙ্গিক।
স্টুডিও ২১-এ সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল ‘ডেলিভারেন্স’ শিরোনামে চন্দ্রিমা রায়ের একক চিত্রপ্রদর্শনী। ১৯৪০-এর দশক থেকে শিল্পের স্বদেশ সন্ধানে লৌকিক পরম্পরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। এই লৌকিকের রয়েছে দু’টি উৎস। একটি এসেছে কৃষিজীবী গ্রামীণ জীবনধারা থেকে। যামিনী রায় বা অবনীন্দ্রনাথের শেষ পর্যায়ের ছবিতে আমরা যার শ্রেষ্ঠ প্রকাশ দেখি। আর একটি এসেছে আদিমতা থেকে। আদিবাসী মানুষের শিল্পের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যা আধুনিকতাকে প্রভাবিত করেছে। চল্লিশের শিল্পী এফ.এন.সুজা-র ছবি এই আদিমতা আত্তীকরণের অন্যতম দৃষ্টান্ত। ষাটের দশকের প্রধান একজন শিল্পী রবীন মণ্ডলও আদিমতাকে প্রকৃষ্ট ব্যবহার করেছেন। |
|
শিল্পী: চন্দ্রিমা রায় |
চন্দ্রিমার ছবিতে লৌকিক ও আদিমতার এক ধরনের সমন্বয় লক্ষ করা যায়। লৌকিকের সারল্য ও সুষমার প্রতিই তাঁর ঝোঁক বেশি। কিন্তু এর ভিতর যে ভাবে তিনি গাঠনিক বলিষ্ঠতা এনেছেন, তাতে আদিমতার প্রচ্ছন্ন উপস্থিতি অনুভব করা যায়। অনেক দিন থেকে তিনি এই আঙ্গিক নিয়ে অনুশীলন করছেন। তাঁর প্রকাশে একটা নির্দিষ্ট অভিমুখ সব সময়ই থেকেছে। ক্রমান্বয়ে সেটা পরিশীলিত হয়েছে। এ বারের প্রদর্শনী দেখে বোঝা যায় এই আঙ্গিকের মধ্য দিয়ে তিনি নিজস্ব একটি বিশ্বদৃষ্টিও গড়ে তুলতে পেরেছেন। তাঁর ঝোঁক থাকে চেতনার ও সৌন্দর্যের মুক্তির দিকে। সংকট, সংঘাত বা সামাজিক আলোড়নকে তিনি এড়িয়ে চলেন। তবু তাঁর প্রকরণের মধ্য দিয়েই মগ্নচেতনার তমসার দূরতর এক ছায়ার অনুপ্রবেশ ঘটে। এই দ্বান্দ্বিকতা তাঁর ছবিকে স্বকীয় এক চরিত্র দেয়।
এই প্রদর্শনীতে তিনি এঁকেছেন ৩০টি ছবি। বোর্ডের উপর অ্যাক্রিলিকে এঁকেছেন। কোথাও কোথাও এর সঙ্গে অয়েল প্যাস্টেলও ব্যবহার করেছেন। রেখা ও রং সমান গুরুত্ব পেয়েছে। প্রশস্ত কালো রেখায় অবয়ব এঁকে মধ্যবর্তী অংশ বর্ণলেপনে ভরাট করেছেন। বর্ণলেপনে পেলবতা পরিহার করে মোটা স্ট্রোকে বলিষ্ঠ বুনোট তৈরি করেছেন। ফলে তাঁর ছবিতে যথেষ্ট ভর এসেছে। লৌকিকের ছন্দিত সুষমার গণ্ডি অতিক্রম করে আদিমতার বলিষ্ঠতার দিকে গেছে। দুইয়ের মধ্যে সমন্বয় তৈরি হয়েছে। এই সমন্বয়েই ছবি বিশেষ এক চরিত্র পেয়েছে। তাঁর বর্ণলেপনের ভিতর খানিকটা উত্তর-প্রতিচ্ছায়াবাদী প্রাকরণিক বৈশিষ্ট্য থেকে যায়। ফলে তা আর শেষ পর্যন্ত প্রাচ্য লৌকিকের সীমায় আবদ্ধ থাকে না। পাশ্চাত্য আধুনিকতার সারাৎসার আত্মস্থ করে বিশ্বগত মাত্রা পায়।
বিষয়ের দিক থেকে তাঁর ছবিতে মানবী চেতনার প্রাধান্য আছে। নারী সত্তার নানা দিককে তিনি বিভিন্ন ভাবে নিরীক্ষণের চেষ্টা করেছেন। ‘লেডি উইথ ফ্লাওয়ার’, ‘লেডি উইথ পিঙ্ক ডোর’, ‘ন্যুড উইথ অরেঞ্জ ব্যাকগ্রাউন্ড’, ‘সিটেড লেডি’ ইত্যাদি নারী-কেন্দ্রিক সব ছবিতেই নারী আন্তর-সত্তার সন্ধান রয়েছে। পাশাপাশি প্রকৃতি নিয়েও তিনি কিছু ছবি করেছেন। গাছ, ফুল, পাতার বিন্যাসের মধ্য দিয়ে সেখানে প্রকৃতির অন্তর্লীন ছন্দের সন্ধান রয়েছে। শুদ্ধ রূপই তাঁর অন্বিষ্ট। সেই রূপের ভিতর দিয়ে চিরন্তনের স্পন্দনকে তিনি ছুঁতে চান। সেই লক্ষ্যে পৌঁছানো অবশ্য খুবই কঠিন। তাঁর নিবিষ্টতা তাঁকে এ বিষয়ে নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। |
|
|
|
|
|