সন্দেহের বিষেই বিপত্তি বারাসতে
গোয়েন্দাদের জেরায় স্ত্রী-হত্যা কবুল স্বামীর
পারিবারিক বিবাদের জেরে খুন হয়েছেন বারাসতের জগন্নাথপুরের মহিলা, ঘটনার পরেই বলেছিলেন পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম। তদন্তের আগেই মন্ত্রী কী ভাবে এ কথা বললেন, তা নিয়ে তখন বিতর্ক হয়েছিল।
মঙ্গলবার নিহত মহিলার স্বামী ময়চেন আলিকে খুনের অভিযোগে গ্রেফতার করে পুরমন্ত্রীর সেই মন্তব্যই ‘সত্য’ বলে দাবি করল সিআইডি। গোয়েন্দাদের বক্তব্য, সন্দেহের বশেই স্ত্রীকে খুন করে নিজে অ্যাসিড খেয়ে গণধর্ষণের গল্প ফেঁদেছিল ময়চেন। ভবানী ভবনে দফায় দফায় জেরার পরে বারাসত আদালতে আবেদন জানিয়ে সিআইডি সাত দিনের জন্য নিজেদের হেফাজতে নেয় তাকে।
ডিআইজি (সিআইডি) বিনীত গোয়েল বলেন, “মৃতার স্বামীর কথায় অনেক অসঙ্গতি ছিল। তাকে জেরা করে এলাকায় তদন্ত চালানো হয়। পারিপার্শ্বিক কারণ খতিয়ে দেখেই গ্রেফতার করা হয় তাকে। সে অপরাধ কবুলও করেছে।” ময়চেন এখন সুস্থ বলে জানান গোয়েন্দারা।
২৯ ডিসেম্বর রাতে জগন্নাথপুরের একটি ইটভাটায় খুন হন ৪৫ বছরের ওই মহিলা। তাঁর স্বামী ময়চেনকে প্রথমে বারাসত এবং পরে আর জি কর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ময়চেনের অভিযোগ ছিল, অন্ধকারে কিছু লোক তার স্ত্রীকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করায় সে বাধা দেয়। তখন মারধর করে তার মুখে অ্যাসিড ঢেলে দেয় দুষ্কৃতীরা। তার পরে দুষ্কৃতীরা তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে। এই ঘটনাই বাড়িতে গিয়ে জানায় ময়চেন। পরে পরিবারের লোকেরা গিয়ে ইটভাটার পুকুরপাড়ে ওই মহিলার অর্ধনগ্ন মৃতদেহ দেখতে পান। পরিবারের তরফে বারাসত থানায় গণধর্ষণের অভিযোগও দায়ের করা হয়। গণধর্ষণ হয়েছে কি না, ময়না-তদন্তের পরেও অবশ্য সেই ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেননি চিকিৎসকেরা।
তদন্তে নেমে পুলিশ প্রথমে ইছা মোড়ল নামে ইটভাটার এক কর্মীকে গ্রেফতার করে। তার পরেই পুরমন্ত্রী মন্তব্য করেন, ‘এটা পারিবারিক বিবাদের ঘটনা।’ প্রথমে ওই মন্তব্যের প্রতিবাদ করেছিলেন মহিলার ছেলে ও পুত্রবধূ। মঙ্গলবার ময়চেনের গ্রেফতারের পরে অবশ্য তাঁরা এই নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে চাননি।
রহস্যভেদের চাবি
• দম্পতি একসঙ্গে ইটভাটা থেকে বেরোন
• আধ ঘণ্টা পরে বাড়ি ফেরেন ময়চেন একা
• স্ত্রীর দেহের পাশে ময়চেনের রক্তমাখা জ্যাকেট
• বাড়িতেও মেলে তার রক্তমাখা সোয়েটার
• ময়চেনের গায়ে কোনও ক্ষত ছিল না
• অ্যাসিড খাওয়ালে তার গায়ে পড়ল না কেন
প্রশ্ন উঠেছে, কেন স্ত্রীকে খুন করে গণধর্ষণের গল্প ফাঁদল ময়চেন?
সিআইডি-র দাবি, বেশ কিছু দিন ধরে মানসিক রোগে ভুগছিল ময়চেন। স্ত্রীর চরিত্র নিয়ে সে সন্দেহ প্রকাশ করত। আলাদা ঘরে থাকত। স্ত্রী ইদানীং বাড়িতেও তার মতামতকে গুরুত্ব দিচ্ছিলেন না বলে সিআইডি-র জেরায় জানিয়েছে ময়চেন। সে গোয়েন্দাদের বলেছে, ইটভাটার কিছু কর্মীর সঙ্গে তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে বলেও সন্দেহ হয়েছিল তার। ইটভাটায় কোনও পুরুষের সঙ্গে কথা বললে সে স্ত্রীকে মারধর করত বলে জেনেছে সিআইডি। গোয়েন্দাদের দাবি, স্ত্রীর উপরে নজরদারি করার জন্যই মাস দুয়েক আগে ময়চেনও ইটভাটায় কাজ নেয়। স্ত্রীকে সন্দেহের কথা এক ‘বন্ধু’কে জানায় সে। ময়চেন গোয়েন্দাদের জানিয়েছে, এমন স্ত্রীকে মেরে ফেলাই ভাল বলে সেই বন্ধু তাকে পরামর্শ দিয়েছিল। সিআইডি-র দাবি, ময়চেন সেই বন্ধুকে জানায়, তার যা শরীরের অবস্থা, তাতে স্ত্রীকে খুন করতে গেলে উল্টে স্ত্রী-ই তাকে মেরে ফেলবে। সেই বন্ধু তাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এই ঘটনায় ধৃত ইছা মোড়লই ময়চেনের সেই ‘বন্ধু’ কি না, সেই বিষয়ে নিশ্চিত নয় সিআইডি। গোয়েন্দারা জানান, খোঁজ চলছে তৃতীয় এক জনেরও। এই কারণ দেখিয়েই এ দিন বারাসত আদালতে ময়চেনকে নিজেদের হেফাজতে নেওয়ার আবেদন জানান তদন্তকারী অফিসারেরা।
খুনটা করা হয় কী ভাবে?
ধৃতকে জেরার ভিত্তিতে সিআইডি জানিয়েছে, ঘটনার দিন বিকেলে স্ত্রীর সঙ্গে ইটভাটা থেকে বাড়ি ফেরার পথে নির্জন জায়গায় বাঁশঝাড়ে ঘেরা একটি পুকুরের কাছে পৌঁছে আচমকা পিছন থেকে স্ত্রীর গলায় গামছার ফাঁস দিয়ে টান মারে ময়চেন। চিৎকার শুরু করেন ওই মহিলা। স্ত্রীকে পুকুরের ধার থেকে নীচের দিকে ঠেলে দেয় ময়চেন। সেখানে হাতুড়ি নিয়ে হাজির ছিল সেই বন্ধু। বেশ কয়েক বার হাতুড়ি দিয়ে মহিলার মাথায় আঘাত করে তারা। দু’জনের জামাকাপড়েই রক্তের ছিটে লাগে। নিজের রক্তমাখা জ্যাকেট জঙ্গলে ফেলে দেয় ময়চেন। তার পরে স্ত্রীর মৃতদেহ ফেলে রেখে বাড়ি ফিরে যায় সে।
গোয়েন্দারা জানান, ময়চেন বাড়ি ফিরে পুত্রবধূর কাছে জানতে চায়, তাঁর শাশুড়ি বাড়ি ফিরেছেন কি না? তার পরেই চানঘরে গিয়ে নিজের রক্তমাখা সোয়েটার খুলে ফেলে সে। তখনই চানঘরে রাখা অ্যাসিডের বোতলটি তার চোখে পড়ে। স্ত্রীকে খোঁজার কথা বলে অ্যাসিডের বোতলটি নিয়ে ইটভাটার দিকে যায় সে। তদন্তকারীদের ধারণা, তার পরে বোতল খুলে কিছুটা অ্যাসিড খাওয়ার পরে গলা জ্বালা করতেই খাওয়া বন্ধ করে দেয় ময়চেন। তার পরে বাড়ি ফিরে গিয়ে জানায়, তাকে জোর করে অ্যাসিড খাইয়ে কয়েক জন তার স্ত্রীকে টেনে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করছে।
গোয়েন্দাকর্তাদের বক্তব্য, স্ত্রীকে খুন করার পরে ইটভাটা সহকর্মীদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনার চেষ্টা করেছিল ময়চেন। গোয়েন্দাদের দাবি, তার মনে হয়েছিল, এতে এক ঢিলে দুই পাখি মারা যাবে। স্ত্রী-হত্যার দায় এড়ানো যাবে এবং খুনের অভিযোগে গ্রেফতার হবে শক্ররা।
রহস্যমোচন হল কী ভাবে?
গোয়েন্দারা বলছেন, জোর করে অ্যাসিড খাওয়ালে বাধা দেওয়াটা স্বাভাবিক। এবং বাধা দিলে ধস্তাধস্তি হবে, শরীরের অন্য অংশে অ্যাসিডের ছিটে পড়বে। অথচ ময়চেনের শরীরের অন্য কোনও অংশে অ্যাসিডের দাগ নেই, অন্য ক্ষতও নেই। রক্তমাখা সোয়েটার, জ্যাকেটও তার দিকে আঙুল তুলেছে।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.